লালমনিরহাটে পাঁচ সাংবাদিককে নিজ কার্যালয়ে আটকে রেখে কারাগারে পাঠানোর হুমকি দেওয়ার ঘটনায় গত ১৪ মার্চ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল নোমান সরকারকে তাত্ক্ষণিক বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা হয়েছে।
এর আগে গত ৫ মার্চ শেরপুরের নকলার ইউএনও কার্যালয়ে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য চেয়ে আবেদন করেন দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার শেরপুরের নকলার উপজেলা সংবাদদাতা শফিউজ্জামান রানা। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া উম্মুল বানিন তথ্য দেননি। উল্টো রানার বিরুদ্ধে তথ্য চাওয়ার নামে গোপনীয় শাখার নারী কর্মকর্তাকে নাজেহাল, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তছনছ এবং ইউএনওর কর্তব্যকাজে বাধাসহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়।
এসব অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী হাকিম শিহাবুল আরিফের ভ্রাম্যমাণ আদালত। রানাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এ নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার মধ্যে রানা অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছেন। এমন ঘটনা শুধু একটি-দুটি নয়, সারা দেশে বিভিন্ন সময় প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের দ্বন্দ্ব দেখা যায়।
অভিজ্ঞজনরা বলছেন, পারস্পরিক মনোভাব ইতিবাচক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ থাকা বাঞ্ছনীয়। মাঠ প্রশাসনের যেসব জেলা-উপজেলায় এসবের ঘাটতি রয়েছে, সেসব জায়গায় সমস্যা হচ্ছে। দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট নেত্রকোনায় স্থানীয় এক সাংবাদিককে ‘মামলায় জড়ানোর হুমকি’ দেওয়ার পর কেন্দুয়ার ইউএনওকে সতর্ক করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।
২০২০ সালের ১৪ মার্চ কুড়িগ্রামে মধ্যরাতে বাড়িতে ঢুকে স্থানীয় সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বছরের কারাদণ্ড দেন। এরপর কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের বদলি-পদোন্নতি হয়েছে যথাসময়ে।
নকলার ইউএনওর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ
নকলায় সাংবাদিক রানাকে শাস্তি দেওয়ার ঘটনায় তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ অনুযায়ী তথ্য সরবরাহে সহযোগিতা না করে তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগকে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। নকলার ইউএনওর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসনের কাছে সুপারিশ করেছে তথ্য কমিশন।
গতকাল মঙ্গলবার তথ্য কমিশন বাংলাদেশের প্রধান তথ্য কমিশনার ড. আবদুল মালেক, তথ্য কমিশনার শহীদুল আলম ঝিনুক এবং তথ্য কমিশনার মাসুদা ভাট্টি তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী শুনানি নিয়ে এই নির্দেশ দেন।
তথ্য কমিশন সূত্রে জানা যায়, গত ১০ মার্চ নকলায় সরেজমিনে তদন্তে যান তথ্য কমিশনার শহীদুল আলম ঝিনুক। গত ১৮ মার্চ অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে অবহিত করেন প্রধান তথ্য কমিশনার ড. আবদুল মালেক।
এ বিষয়ে তথ্য কমিশনার শহীদুল আলম ঝিনুক কালের কণ্ঠকে জানান, তথ্য অধিকার আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী তিনি তদন্ত করেছেন।
এদিকে নকলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মুনসুরের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগ উঠেছে সাংবাদিক রানার বিরুদ্ধে। এর প্রতিবাদে মানববন্ধন হয়েছে।
এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ী প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও যুগান্তরের প্রতিনিধি এম এ হাকাম হীরা কালের কণ্ঠ বলেন, অনেক সাংবাদিক সাংবাদিকতার প্রাথমিক নর্মস বা ইথিকস মানছেন না। অনেক প্রতিষ্ঠান যেনতেনভাবে একটি আইডি কার্ড দিচ্ছে। ইনহাউস প্রশিক্ষণ ও বেতনের খবর নেই। এ জন্য এসব ঘটনা বেশি ঘটছে। আবার মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা নিজেকে অতিরিক্ত প্রভাবশালী মনে করছেন। অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়েও এমন ঘটনা ঘটছে। এ জন্য উভয় পক্ষের সচেতন হওয়া উচিত।
তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের বিধান করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯। এই আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার রয়েছে। কোনো নাগরিকের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য।
তথ্য প্রকাশের ধারা মানায় তোড়জোড়
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তারা বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া বেতার কিংবা টেলিভিশন অথবা কোনো সংবাদপত্র বা সাময়িকীতে নিজ নামে অথবা বেনামে বা অন্যের নামে কোনো নিবন্ধ বা পত্র লিখতে পারেন না। খসড়া আচরণবিধিতে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট করোনাকালে আচরণবিধির এই ধারা মানার বিষয়ে মনে করিয়ে দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, শেরপুর ও রংপুরের অন্তত ২০ জন সাংবাদিক কালের কণ্ঠকে বলেন, মাঠ প্রশাসনের কোনো তথ্য জানতে গেলে বেশির ভাগ কর্মকর্তা বলেন, আচরণবিধি অনুযায়ী তাঁরা গণমাধ্যমে কথা বলতে পারেন না।
করোনাকালের নির্দেশনার পর এই প্রবণতা বেড়েছে। আচরণ বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা রয়েছে। দেশে বা বিদেশে কারো কাছ থেকে উপহার বা পুরস্কার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত ব্যবসা, রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী সহকর্মীর সঙ্গে আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে, তার নির্দেশনা আছে। এগুলোর বেশির ভাগই মানছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু গণমাধ্যমের এই ধারা মানতে কেন্দ্র থেকে মাঠ প্রশাসনে সবচেয়ে বেশি তোড়জোড় দেখা যায়।
১০ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি আচরণবিধি
দীর্ঘ ১০ বছরেও সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। এর আগে ২০০২ ও ২০১১ সালে দুই দফায় এই বিধিমালা সংশোধন করা হয়। এর পরও কিছু বিষয় অস্পষ্ট থাকায় ২০১৪ সালে আবার বিধিমালা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। কিন্তু এখনো বিধিমালার সংশোধনের জন্য শুধু বৈঠক হচ্ছে। এ জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থও ব্যয় হয়েছে। আচরণবিধি চূড়ান্ত হয়নি।
সাংবাদিকরাও মানছেন না আচরণবিধি
প্রেস কাউন্সিল প্রণীত সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় আচরণবিধি ১৯৯৩-এর বেশির ভাগ ধারা মানছেন না সাংবাদিকরা। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে নিয়মিত কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। ফলে সাংবাদিকরা কর্মক্ষেত্রে কেমন আচরণ করবেন, তা নিয়ে তৈরি হয় বিরোধ। বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকরা এ নিয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, যে প্রক্রিয়ায় সাংবাদিক রানাকে সাজা দেওয়া হয়, তা যথাযথ হয়নি। এতে ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্পর্কে অনেকের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি চাকুরে, সাংবাদিক ও সাধারণ নাগরিক—সবাই এ দেশের সন্তান। সবারই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। সবার প্রতি সবার ইতিবাচক মনোভাবও থাকা দরকার। যেসব উপজেলায় এ সম্পর্ক নেই, সেখানেই সমস্যা হচ্ছে। হয়তো সাংবাদিক সাহেব জোরজবরদস্তি করেন, অফিসার তখন শক্তি প্রয়োগ করেন। এমনটি কারো জন্যই ভালো নয়। ইউএনও এবং ডিসির চাকরি সেমিপলিটিক্যাল। তাঁদের পাবলিকের সহায়তায় অনেক কাজ করতে হয়। এ ছাড়া তাঁরা জেলা ও উপজেলায় জাতীয় সরকারের প্রতিনিধি। তাঁদের ধৈর্যশীল হতে হবে। শক্তি প্রয়োগ করে নয়, আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সাংবাদিকদেরও জোরজবরদস্তি করে নয়, বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলেই সংকটের সমাধান হবে।
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে সহনশীলতার চেয়ে উত্তাপই বেশি। তাই সমস্যা হচ্ছে। উভয় পক্ষ সহনশীল হলে সমস্যা হবে না।’
জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, করোনাকালের আদেশে সাংবাদিকদের জন্য তথ্য পাওয়ায় কোনো সমস্যা হয়নি। তাঁদের তথ্য বাধাগ্রস্ত করাও এর উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সঠিক তথ্য দেওয়া।
তিনি জানান, এটি নতুন কোনো আদেশ বা আইন নয়, পুরনো আইনটিই প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার ২২ নম্বর বিধি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তবে উদ্ভাবনমূলক কোনো কাজের জন্য বিভাগীয় প্রধানদের আগাম অনুমোদন লাগবে না। এ ছাড়া সাম্প্রতিক যে ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন