‘হাসপাতালে নেওয়ার আগে আমার বাচ্চাটা প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিল। বলছিল– বাবা, তুমি তো আমার পাশেই থাকবে। এর পর যখন অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয় তখন বলছিল– বাবা, আমার সাহস আছে, তুমি টেনশন করো না।’ খতনা করাতে গিয়ে মঙ্গলবার মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে মারা যায় ১০ বছরের শিশু আহনাফ তাহমিদ আলম আয়হাম। গতকাল বুধবার দুপুরে ছেলের লাশ নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন তাহমিদের বাবা ফখরুল আলম। সে সময় তিনি এসব কথা বলেন।
সন্তানহারা বাবার চোখের কোণ গলিয়ে কখনও নীরবে অশ্রু ঝরছিল। আবার কখনও করছিলেন বুকফাটা আর্তনাদ। অস্ত্রোপচারের আগে ছেলের সঙ্গে কথোপকথনের স্মৃতিচারণ করে ফখরুল বলছিলেন, বাবাকে নির্ভয় দেওয়া ছেলেটাকে এভাবে মেরে ফেলা হলো! অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগেই হাত নেড়ে বিদায় নিয়েছিল তাহমিদ। কে জানত– এটাই সন্তানের শেষ বিদায়! ১০ বছর ওর সবকিছু আমি করতাম। স্কুলে আনা-নেওয়া করতাম।
মর্গের সামনে গিয়ে দেখা গেল, আত্মীয়স্বজন অনেকে তাহমিদের বাবা ফখরুলকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তবে সন্তান হারানোর শোক কী করে সহ্য করবেন বাবা? ফখরুল বললেন, কাঁধে ছোট্ট সন্তানের লাশ বয়ে নিয়ে যাব– এটাও দেখা লাগল! বলছিলেন, ‘ওই ঘরের মধ্যে তাহমিদকে রাখা হয়েছে। আমার তাহমিদ ওখানে থাকতে পারবে না। ও কখনও এসব জায়গায় থাকেনি। বের করে নিয়ে আসো। আমি ওকে বাসায় নিয়ে যাব। ওর আম্মু অপেক্ষা করছে।’
স্বজনরা তাঁকে সান্তনা দিতে গিয়ে কান্না থামিয়ে রাখতে পারছিলেন না। তাহমিদের খালু মোতাহার হোসেন বলেন, সন্তান হারানোর শোকে পাগলপ্রায় তাহমিদের মা খায়রুন নাহার চুমকি। বাসায় ছেলের স্কুল ড্রেস জড়িয়ে বিলাপ করে যাচ্ছে। বাসের নিচে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করতে রাস্তায় বেরিয়ে যাচ্ছে। শান্ত করা যাচ্ছে না। ঘুমের ওষুধ দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে ফ্রিজ রুম থেকে তাহমিদের মরদেহ বের করে নেওয়া হয় ময়নাতদন্তের জন্য ডোম ঘরে। এ সময় ট্রলির ওপর ছেলের নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে আহাজারি করতে দেখা যায় ফখরুলকে। তিনি বলতে থাকেন, ‘ওরা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি ওদের বিচার চাই; আমি এদের ফাঁসি চাই।’ ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর ২টার পর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাকে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা সদরের আলেখার চরে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
তাহমিদ মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। খিলগাঁও রেলগেট এলাকার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবেশী ও স্বজনরা তাহমিদের মা চুমকিকে ঘিরে বসে আছে। তিনি তখন প্রায় অচেতন। তাহমিদের কয়েকজন সহপাঠীও এসেছে। তারাও কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
তাহমিদের খালু মোতাহার হোসেন বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টায় ফোন করে ওর আম্মু বলছিল, দুলাভাই, তাহমিদকে খতনা করাতে হাসপাতালে নিয়ে এলাম। অ্যানেসথেশিয়া দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরছে না। এর ১০ মিনিট পর ফোন দিয়ে কী অবস্থা, জানতে চাই। বলে– ছেলে আর নেই।
তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে ওর আম্মু ১০-১৫ বার জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান ফিরলেই ছেলে তাহমিদের স্কুলের ড্রেস নিয়ে এ ঘর-ও ঘর খুঁজছে। ড্রেস না পেলে বাসা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে রাস্তায় চলে আসছে। গাড়ির নিচে মাথা দেবে; আত্মহত্যা করবে– এসব বলছে। আত্মীয়স্বজন থামালেই জ্ঞান হারাচ্ছে। ছেলেকে হারিয়ে ওর বাবা-মা কী করে বাঁচবে? কীভাবে ওদের সান্তনা দেব– সেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকার জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে নেওয়া হয় তাহমিদকে। অভিযোগ উঠেছে– সেখানে অ্যানেসথেশিয়া প্রয়োগ করে খতনা করাতে গেলে মারা যায় শিশুটি। ওই ঘটনায় শিশুটির বাবা বাদী হয়ে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন। এজাহারে তিনজনের নাম উল্লেখ করে আরও চারজন ডাক্তার ও নার্সকে অজ্ঞাত আসামি করেছেন। আসামিরা হলেন– জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারের (এটি জে এস হাসপাতাল নামে পরিচিত) পরিচালক এসএম মোক্তাদির হোসেন, মাহবুব মোরশেদ ও ইশতিয়াক আজাদ। তাদের মধ্যে মোক্তাদির ও মাহবুবকে গ্রেপ্তার করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। আত্মগোপনে রয়েছেন ইশতিয়াক।
তাহমিদের বাবা ফখরুল আলম কান্নাজড়িত কণ্ঠে সমকালকে বলেন, আমার ছেলে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক কাজে ও সবার আগে ছুটে যায়। ক্লাস ক্যাপ্টেন হয়েছে এবার। সবার সঙ্গে ওর খুবই ভালো সম্পর্ক। শিক্ষকরাও তাকে খুব পছন্দ করেন। আর ছোট ছেলে আহিন আয়মান (৬) পড়াশোনা করে ফয়জুর রহমান আইডিয়ালে প্রথম শ্রেণিতে। দুই ভাই বাসায় থাকলে সারাদিন খুনসুটি চলতেই থাকে। ওদের জন্য আমার ঘর থেকে কখনও হাসি আর আনন্দ ফুরাত না।
তিনি বলেন, অ্যানেসথেটিক পুশ করার সময় চিকিৎসকরা তাঁর কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি। এ ছাড়া আগে একটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় সতর্কতার জন্য আমি নিজ থেকেই চিকিৎসকদের অ্যানেসথেটিকের পুরো ডোজ ব্যবহার করার ব্যাপারে নিষেধ করি। এ সময় চিকিৎসক মোক্তাদির ধমক দিয়ে বলেন, চিকিৎসকদের চেয়ে বেশি বুঝলে এখানে নিয়ে আসছেন কেন? আমার আয়হামকে ওরা হত্যা করেছে। আমি এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আর কোনো বাবা-মায়ের বুক যেন এভাবে খালি হতে না হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চাই। ফখরুল অভিযোগ করেন, ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসককে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ছাড়া ডাক্তারকে বাঁচানোর জন্য সকাল থেকে বসিয়ে রেখে দুপুর প্রায় ১টার দিকে ময়নাতদন্ত শুরু করা হয়। এই রিপোর্টও সঠিক দেবে কিনা– সন্দেহ আছে। এ ঘটনায় জড়িত চিকিৎসককে বাঁচাতে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ভুল দিতে পারে।
তাহমিদের মৃত্যুর বিষয়ে যা জানা গেল
তাহমিদের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবার করা মামলায় দুই চিকিৎসক মোক্তাদির হোসেন ও মাহবুব মোর্শেদকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এতে উঠে আসে– দুই বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে মাহবুব অ্যানেসথেশিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করে এলেও তাঁর কোনো নিবন্ধন নেই। অ্যানেসথেশিয়া করতে হলে বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথোলজিস্টের সদস্য হতে হবে। তবে মাহবুব ওই সংগঠনের সদস্য নন। এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সদস্য না হয়েও তিনি চিকিৎসা করে যাচ্ছিলেন। রাজশাহীর একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে মাহবুব ডিপ্লোমা করেছেন। গ্রেপ্তার আরেক চিকিৎসক মোক্তাদির গাজীপুরের ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন। জেএসএস নামে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোক্তাদিরকে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
হাতিরঝিল থানার ওসি শাহ মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন সমকালকে বলেন, ঘটনার পরেই দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের আদালতে তোলা হলে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আরেক চিকিৎসক আজাদকে খোঁজ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালের পরিচালক মোক্তাদির হলেন তাহমিদের এক বন্ধুর বাবা। মোক্তাদিরের ছেলে তাহমিদের সঙ্গে পড়ে। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরেই সেখানে সন্তানের খতনা করাতে নিয়ে যান তাহমিদের বাবা। তবে শুরুতে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে নিয়ে যেতে চাননি। স্ত্রী সায় দিলে তাহমিদকে জে এসে নিয়ে তাকে হারাতে হলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেসথেশিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, ঘটনার পর থানায় বিএসএমএমইউর একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়। মাহবুব নামে কোনো নিবন্ধনকৃত অ্যানেসথেশিওলজিস্ট নেই– এটা নিশ্চিত হয়েছি।
যা ঘটেছিল
তাহমিদকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার পর তার মা-বাবাকে জানানো হয়, ২০-২৫ মিনিট সময় লাগবে। আধা ঘণ্টার বেশি পার হলে অপারেশন থিয়েটারের দরজা নক করলে বলা হয়, আর অল্প কিছু সময় লাগবে। এভাবে এক ঘণ্টা পার হয়ে যায়। তখন ফখরুল ভেতরে ঢুকতে চাইলে বলা হয়, আর একটু সময় অপেক্ষা করুন। এর পর সন্দেহ হলে জোর করেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যান ফখরুল। দেখেন, ছেলে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। চিকিৎসকরা বুকে হাত দিয়ে চাপাচাপি করছেন। এ সময় চিকিৎসক মোক্তাদিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি সঠিক উত্তর দেননি। অন্য হাসপাতালে পরিবারের সদস্যরা নিতে চাইলেও কর্ণপাত করেননি চিকিৎসক। এক পর্যায়ে তাহমিদের বাবাকে জোর করে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে দেওয়া হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন