নিজের কাজে বাইরে ব্যস্ত ছিলেন পল্লী চিকিৎসক নাসিম উদ্দিন। বাড়ির অন্য লোকজনও ব্যস্ত ছিলেন নিজ নিজ কাজে। এ সময় অন্যান্য দিনের মতো বাড়ির আঙিনায় খেলছিল ১৪ মাস বয়সী শিশু আফিম উদ্দিন। খেলতে-খেলতেই সে পাশে থাকা একটি পানিভর্তি বালতিতে পড়ে যায়। তার মা কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসে দেখেন ছেলে বালতির মধ্যে উল্টে পড়ে আছে। উদ্ধার করে দেখা যায়, সে মারা গেছে। মঙ্গলবার (২৩ মে) বিকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ঘটে মর্মান্তিক এই ঘটনা।
গত মার্চেও একই রকম ঘটনা ঘটে চাঁদপুরের এক গ্রামে। ঘরের চৌকির ওপর ছিল শিশু আমেনা। বিছানার পাশে বালতিতে তুলে রাখা ছিল পানি। একসময় চৌকিতে থাকা শিশু আমেনা হামাগুড়ি দিতে গিয়ে বালতিতে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় এবং ২০১৯ সালে রাজধানীর ডেমরাতেও এমন ঘটনার খবর পাওয়া যায়।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার খুবই ভয়াবহ। একটি জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দেড় বছরে এক হাজার ৪০০ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে, যাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশই শিশু। তবে, ২০১৬ সালে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৪ হাজার ৪৩৮ জন ১৮ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সী শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, দৈনিক ৪০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন এবং এক থেকে চার বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর ঘটনার ৪৩ শতাংশই পানিতে ডোবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অসংখ্য পুকুরসমৃদ্ধ পল্লী অঞ্চলগুলো এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপ্রবণ।
শিশুর জন্য সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান বাসা। সেখানেও একের পর এক বালতির পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বিস্মিত করে শিশু অধিকারকর্মীদের। তাদের প্রশ্ন, যারা শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে কাজ করেন, তারা কি একবারের জন্যও এই নতুন নতুন ইস্যুগুলো সংযুক্ত করে কর্মসূচি হাতে নিচ্ছি?
ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর ড্রাউনিং প্রিভেনশনের আহ্বায়ক সদরুল হাসান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘরে ঘরে গিয়ে মনিটর করা সম্ভব না। অভিভাবক ও কেয়ার গিভারদের সচেতন করার কাজটি আরও বিস্তৃত অর্থে করতে হবে। ৫ বছরে নিচে শিশুদের নিয়ে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। বালতিতে পানি জমাতে নিষেধ করা যাবে না। কারণ, অনেক জায়গায় পানি ধরে রাখতে হয়। ফলে বাথরুম বন্ধ রাখতে হবে। এবং শিশু যেন খুলতে না পারে সেজন্য একটু ওপরের দিকে দরজার সিঁটকিনি দেওয়া দরকার।’
এনএডিএফের নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা সেলিনা আহমেদ বলেন, ‘বালতির পানির মধ্যে ছোট শিশু পড়ে গিয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি আগে অ্যাড্রেস করা হতো না। কেবল হাঁটতে শিখেছে যে শিশু, তাকে চোখে চোখে রাখতে হয়। আমরা ভাবি, বাড়ির মধ্যে শিশু সুরক্ষিত। কিন্তু এভাবে দুর্ঘটনা ঘটে সেটা কারোর চিন্তাতেও আসবে না। ফলে সচেতনতা কর্মসূচির জায়গায় আরও সুনির্দিষ্ট হতে হবে। কর্মজীবী বাবা মা যার কাছে শিশুকে রেখে যাচ্ছেন, তাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যারা পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সচেতনতার কাজ করছেন, তাদের এই নতুন শঙ্কার জায়গায় কাজ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের নিয়ে যে এই কাজগুলো হচ্ছে— এমন মনে হয় না। এটা এখনও অগ্রাধিকার হিসেবে আসেনি। এই ইস্যুগুলো আর সুনির্দিষ্ট হতে হবে । বাসাবাড়িতেও কীভাবে এ ধরনের মৃত্যু ঘটে এবং সেটা কীভাবে রোধ করা যায়, সেখানে জোরেশোরে কাজ করা জরুরি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন