অভিধানে এত দিন শুধু ভোট শব্দই ছিল। এখন চাইলে ভোট-সম্পর্কিত আরও দুটি শব্দ যোগ করা যায়। এর একটি ‘দিনের ভোট’ অন্যটি ‘রাতের ভোট’। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত শব্দগুলোর মধ্যে ওই দুটি অন্যতম।
অতি সম্প্রতি আরেকটি শব্দ রাজনীতিতে বেশ আলোচিত হচ্ছে, সেটি হলো ‘ভোট কক্ষে ডাকাত’। ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট গ্রহণের সময়ই এই ডাকাতদের কেবল দেখা যায়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের ধরা যায় না।
ভোটকক্ষের ডাকাতের মতো নির্বাচনের নতুন মডেল দেশে সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত হওয়ায় রাজনীতির ‘শব্দভান্ডারে’ আরেকটি শব্দ যুক্ত হয়েছে। এ জন্য অবশ্য অনেকের কৃতিত্ব রয়েছে। তবে একজনের নাম না নিলে বিষয়টি অপূর্ণ থাকবে। কারণ, তাঁর নামেই নির্বাচনী এই ‘মডেলের’ নামরকরণ হয়েছে। তিনি উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সংসদ থেকে পদত্যাগের পর বিএনপি ছাড়েন তিনি। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যেভাবে তাঁকে সংসদে ফিরিয়ে আনা হলো, সেটি নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘উকিল সাত্তার মডেল’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। সামনের রাজনীতিতে এই ‘উকিল সাত্তার মডেল’ নানাভাবে দেখা যেতে পারে, এমন আলোচনা রাজনীতিতে রয়েছে।
ধরা যাক, সংসদ নির্বাচনে জালিয়াতির অভিপ্রায় থেকে ক্ষমতাসীন দলকে সুবিধা দিতে (আবার ক্ষমতায় আসতে) ভোটার তালিকায় নির্বাচন কমিশন যদি ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার ঢুকিয়ে দেয়, তাহলে এই ঘটনা রাজনীতিতে কীভাবে পরিচিত হবে। সহজ ভাষায় বিষয়টি মানুষকে বোঝানোর জন্য কী বা কোন ধরনের শব্দ প্রয়োগ করা জুতসই হবে, সে উদাহরণও দেশের মানুষের সামনে রয়েছে। ২০০৭ সালে এ বিষয় রাজনীতিবিদেরা খুব সহজভাবে, এককথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন মাত্র দুটি শব্দ ব্যবহার করে, সেটি হলো ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’। ইংরেজি শব্দ হলেও এর ভাব বুঝতে মানুষের মোটেও সমস্যা হয়নি।
২০১৪ সালে রাজনীতির ‘ভাষার ভান্ডারে’ দুটি শব্দ জনপ্রিয় হয়েছে। এর একটি ‘একতরফা নির্বাচন’ অন্যটি ‘বিনা ভোটে জয়ী’। সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় ও সংসদীয় বিভিন্ন আসনের নির্বাচনে ওই দুটি বিষয় মানুষ বহুবার দেখেছে এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ‘কৌশলের’ অংশ হয়ে গেছে ‘একতরফা’ ও ‘বিনা ভোটের’ নির্বাচন।
নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে পরে অবশ্য ওই ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর বাংলা প্রতিশব্দও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। রাজনীতিবিদদের কেউ বলেছেন ‘সাজানো নির্বাচন’। আবার কেউ বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্রের নির্বাচন’ বা ‘পাতানো নির্বাচন’।
২০১৪ সালে রাজনীতির ‘ভাষার ভান্ডারে’ দুটি শব্দ জনপ্রিয় হয়েছে। এর একটি ‘একতরফা নির্বাচন’ অন্যটি ‘বিনা ভোটে জয়ী’। সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় ও সংসদীয় বিভিন্ন আসনের নির্বাচনে ওই দুটি বিষয় মানুষ বহুবার দেখেছে এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ‘কৌশলের’ অংশ হয়ে গেছে ‘একতরফা’ ও ‘বিনা ভোটের’ নির্বাচন।
আর এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজনীতির ভাষার ভান্ডারে যে শব্দটি বেশ সাড়া ফেলেছে, সেটি হলো ‘গায়েবি মামলা’। এত দিন রাজনৈতিক নেতারা বক্তব্য-বিবৃতিতে মিথ্যা মামলা, হয়রানির মামলা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলার কথা বলে আসছিলেন। ‘গায়েবি মামলার’ ধারণা দেশে নতুন এবং প্রতিপক্ষকে ‘চাপে’ এবং ‘দৌড়ের ওপর রাখতে’ এর কার্যকারিতা রাজনীতিতে ইতিমধ্যে প্রমাণিত।
কোন দল কখন আন্দোলন করবে-এ ক্ষেত্রে যে শব্দ মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে, সেটি হলো ‘ঈদের পরে’। কোনো আলাপে কেউ যদি বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন এবং ঈদের পরে শব্দ ব্যবহার করেন, তাহলে বহু মানুষ সরকারবিরোধী আন্দোলনের কথা ভেবে ভুল করতে পারে।
গত ৩৩ বছরে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত দুটি শব্দের তালিকায় একেবারে শীর্ষে থাকবে ‘সূক্ষ্ম’ ও ‘স্থূল’। প্রথমটির জন্ম ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। দ্বিতীয়টির উদ্ভব ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর।
সুষ্ঠু ভোটে যদি কোনো রাজনৈতিক দল পরাজিত হয়, তাহলেও কি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা সম্ভব?
সহজ উত্তর হচ্ছে, সম্ভব। বলে দিতে হবে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে।
দেশ–বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরও যদি কোনো দল পরাজয় মানতে না চায়, তাহলে কোন ধরনের অভিযোগ সামনে আনা উচিত?
উত্তর হচ্ছে, শীর্ষ পর্যায় থেকে বলতে হবে, ‘স্থূল কারচুপি’ করে জনগণের রায় কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
কারচুপি শব্দের আগে কখন ‘সূক্ষ্ম’ যোগ করতে হয় আর কখন ‘স্থূল’ হবে—কোনো ভাষাবিদ, ব্যাকরণবিদ বা বাংলা ভাষাতত্ত্বের কোনো গবেষক তা ঠিক করেননি। এই কাজটি ঘটনার (পড়ুন নির্বাচনের ফলাফল) সঙ্গে মিলিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায় থেকে ঠিক করা হয়েছে। অনেকের দ্বিমত থাকলেও বহু মানুষ ওই শব্দ প্রয়োগের (দুবার) সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন এবং তা দেশের রাজনীতির ‘ভাষার ভান্ডারে’ যুক্ত হয়ে জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
গত ৩৩ বছরে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত দুটি শব্দের তালিকায় একেবারে শীর্ষে থাকবে ‘সূক্ষ্ম’ ও ‘স্থূল’। প্রথমটির জন্ম ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। দ্বিতীয়টির উদ্ভব ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর।
রাজনীতিতে কোন শব্দ বা শব্দযুগল কোন সময়ের জন্য জুতসই হবে, সেটি ঠিক করে দেওয়ার এখতিয়ার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছেন রাজনীতিবিদেরা। বিশেষ করে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ‘উত্তরণ’ পর্বের শুরু থেকে অর্থাৎ গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে যাঁরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর নিয়মিত রাখেন, তাঁরা কিছু শব্দের সঙ্গে বেশ পরিচিত। এর মধ্যে কয়েকটি শব্দ বা শব্দযুগল ‘কালজয়ী’ হয়ে উঠেছে।
আবার নতুন শব্দ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে নতুনভাবে জনপ্রিয় হয়েছে গণসমাবেশ, গণপদযাত্রা, গণমিছিল ও গণ–অবস্থান—এসব শব্দ। অবশ্য মানববন্ধনের নতুন কোনো রূপ আসেনি এখনো। এক দল যেহেতু জনবান্ধব শব্দ মুখে–লেখায় ব্যবহার করে, তাই অন্য দল বিষয়টিকে ‘গণবান্ধব’ করে দিয়েছে। অবশ্য এসব নামকরণ ভুল বা অসংগতিপূর্ণ নয়। এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, অন্য দলের চেয়ে ভিন্ন কিছু বলতে হবে, করতে হবে। তবে প্রতিপক্ষকে তুচ্ছ বা কটাক্ষ করতে ‘ভুয়া’ শব্দ সব দলের কাছে এখনো সমান জনপ্রিয়।
এককভাবে কোনো রাজনীতিবিদ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতির ‘শব্দভান্ডারকে’ সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অন্য যে কারও চেয়ে এগিয়ে থাকবেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি কখনো দলের ভেতরকার অবস্থা বোঝাতে, কখনো প্রতিপক্ষের উদ্দেশে যেসব শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেছেন, তা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। বিশেষ করে হাইব্রিড নেতা, মশারির ভেতরে মশারি, ঘরের মধ্যে ঘর, নেতার কারখানা, সিকি নেতা, আধুলি নেতা, পাতিনেতা, বিভেদের দেয়াল, প্রচার লীগ, তরুণ লীগ, কর্মজীবী লীগ, ডিজিটাল লীগ, হাইব্রিড লীগ, ভেতরে-ভেতরে কাউয়া (কাক) আছে কিংবা ক্ষমতার সঙ্গে কাউয়া ঢুকে যায়—এর মতো শব্দ ও বাক্যগুলো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। চাইলে এই তালিকা আরও লম্বা করতে পারবে যে কেউ।
আর গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির আলোচিত গণসমাবেশের আগে–পরে অন্তত চার মাস ওবায়দুল কাদের যত বক্তৃতা দিয়েছেন, তার প্রায় প্রতিটিতে ‘খেলা হবে’ শব্দযুগল তিনি ব্যবহার করেছিলেন। রাজনীতির ভাষা হিসেবে ‘খেলা হবে’ শব্দযুগলকে তিনি জনপ্রিয় করলেও এর ‘আবিষ্কারক’ অবশ্য তিনি নন। তবে তাঁর দলেরই আরেক নেতা নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান এক বক্তৃতায় প্রতিপক্ষের উদ্দেশে ব্যবহার করেছিলেন ‘খেলা হবে’, যা পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
কোনো দল সংলাপে আগ্রহী না হওয়ার পরও চিঠি দিয়ে যদি নির্বাচন কমিশন ‘চাপাচাপি’ করে তাহলে কোন শব্দ ব্যবহার করা যুতসই হবে? এর উত্তর দিতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতির ‘শব্দভান্ডারে’ সর্বশেষ সংযোজন। আর এই শব্দটি হলো ‘লেটেস্ট কৌশল’।
১৯৯১ সাল থেকে দেশের প্রতিটি নির্বাচনের সময় রাজনীতির শব্দভান্ডারে নতুন কিছু যুক্ত হচ্ছে। সামনে আবার নির্বাচন আসছে। এবার কী যুক্ত হতে যাচ্ছে, সে অপেক্ষায় থাকতে হবে সবাইকে।
শেষ করার আগে একটি কথা। ধরুন, আপনি যদি কারও কাছ থেকে সময় নিয়ে দেখা করেন, কথা বলেন—তাহলে সেটি বড়জোর ‘আলাপ’ হবে। একই কাজ যদি রাজনৈতিক দল করে, তাহলে সেটি হয়ে যাবে ‘সংলাপ’। আর সংলাপে যদি কোনো ফল আসে না, সেটি রাজনীতির ভাষায় হয়ে যাবে ‘প্রলাপ’।
ইমাম হোসেন সাঈদ ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন