বহুল প্রচলিত আইনি প্রবাদ হচ্ছে- ‘বিচার বিলম্বিত হওয়া মানে বিচার না হওয়া।’ দেশে বিলম্বিত বিচারের সুযোগে দুর্নীতির মামলার প্রভাবশালী আসামিরা বছরের পর বছর ধরে থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে সারাদেশে ধর্ষণ, ডাকাতি, অপহরণ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে উচ্চ ও নিম্ন আদালতে ৪২ লাখ মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের হওয়া ৬ হাজার ২৬৪টি মামলা রয়েছে। দুর্নীতির মামলাগুলোর মধ্যে বিচারিক আদালতে ৩ হাজার ৩২৬টি এবং হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে ২ হাজার ৯৩৮টি মামলা বিচারাধীন। আবার উচ্চ আদালতের নির্দেশে ৪১৬ মামলার বিচার বছরের পর বছর ধরে স্থগিত হয়ে আছে। ফলে শাস্তি না হওয়ায় আসামিরা নতুন করে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকট হচ্ছে। অথচ মামলাগুলো নিষ্পত্তি হলে (সাজার হার ন্যূনতম ৬০ শতাংশ অনুযায়ী) ৩ হাজার ৬৫০ জন আসামির শাস্তি নিশ্চিত হতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, অধিকাংশ মামলার আসামিরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাদের মধ্যে রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এসব আসামির তালিকায় গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য বিভাগ, তিতাস গ্যাস, সাব-রেজিস্ট্রার, পাসপোর্ট ও বন বিভাগের কর্মকতা-কর্মচারী বেশি। এ ছাড়াও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা, রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিরাও রয়েছেন আসামির খাতায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা সংক্রান্ত গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৪ সালে আইন করে দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠিত হয়। তখন ব্যুরো আমলে ঝুলে থাকা কয়েক হাজার মামলার দায়িত্ব পড়ে দুদকের ওপর। এরপর গত ১৮ বছরে অধিকাংশ মামলা নিষ্পত্তি হলেও এখনো ব্যুরো আমলের ৪১৫টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ১১৫টি ঢাকার বিচারিক আদালতে এবং বাকি তিন শতাধিক মামলা দেশের অন্যান্য আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার মধ্যে হাইকোর্টের আদেশে ৪১৬টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এর মধ্যে দেড় যুগ আগে ব্যুরো আমলে দায়ের হওয়া ১৮৫টি মামলাও রয়েছে। অপরদিকে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ক্রিমিনাল মিস, ক্রিমিনাল আপিল, ক্রিমিনাল রিভিশন এবং ক্রিমিনাল রিট মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৬২৪টি রিট, ৭৯৩টি ফৌজদারি বিবিধ মামলা, ১ হাজার ৮টি আপিল মামলা এবং ৫১৩টি ফৌজদারি রিভিশন মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন সময় দায়ের হওয়া নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার মধ্যে ঢাকায় ৯৩০টি এবং ঢাকার বাইরের আদালতগুলোতে ২ হাজার ৩৯৬টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে দুদকের বিশেষ তদন্ত অনুবিভাগের অধীনে দায়ের হওয়া প্রায় ৫০০ মামলা নিম্ন আদালতে বিচারাধীন। আর ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহ নিয়ে তদন্ত-১ অনুবিভাগের ৪৬৩ মামলা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট নিয়ে তদন্ত-২ অনুবিভাগের অধীনে ১ হাজার ৪২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অন্যদিকে মানিলন্ডারিংয়ের ৬০টি মামলা ছাড়াও ব্যাংক খাতের ২৪টি, বীমা খাতের ৫৩টি মামলা ছাড়াও অন্যান্য খাতের বেশকিছু মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
দুদকের পরিসংখ্যানে বিচারিক আদালতে যে ৩ হাজার ৩২৬টি মামলা বিচারাধীন, যা গত পাঁচ বছরে দায়ের হওয়া মোট মামলার চেয়ে দ্বিগুণ। গত পাঁচ বছরে ১ হাজার ৬৮০টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। এর মধ্যে গত বছর (২০২২) ৪০৬টি, ২০২১ সালে ৩৪৭টি, ২০২০ সালে ৩৪৮টি, ২০১৯ সালে ৩৬৩টি এবং ২০১৮ সালে ২১৬টি মামলা। এই পাঁচ বছরে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ২৯১টি মামলা। এর মধ্যে গত বছর ৩৪৬টি মামলা আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে। এ সময় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে ১ হাজার ২১৫টি।
অন্যদিকে, গত বছর নিষ্পত্তি হওয়া কমিশনের মামলাগুলোর মধ্যে সাজার হার ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর আগের বছর ২০২১ সালে ৬০ শতাংশ, ২০২০ সালে ৭২ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৬৩ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ৬৩ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ৬০ শতাংশ এবং গড়ে প্রায় ৬৫.৫ শতাংশ মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। সে হিসাবে ছয় হাজার মামলার বিচারকাজ শেষে হলে সাড়ে তিন হাজারের বেশি আসামির সাজা নিশ্চিত হতো।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এ বলা আছে, ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। এ আইনের ধারা ২০ক-এর উপধারা (১) বলা আছে- অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, ধারা ২০ক-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্তির তারিখ থেকে অনধিক ১২০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে। উপধারা (২) এ বলা আছে- যুক্তিসঙ্গত কারণে নির্ধারিত সময়সীমার (১২ কার্যদিবস) মধ্যে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব না হলে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য কমিশনের নিকট আবেদন করতে পারবেন এবং এক্ষেত্রে কমিশন আরও ৬০ কার্যদিবস সময় বৃদ্ধি করতে পারে। তবে দুদকের মামলার একটি বড় অংশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ হয়নি। যার ফলে মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়।
দুদকের হিসাবে, গত বছর বিচারিক আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার ১০ শতাংশ। অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগে মামলার নিষ্পত্তির হার ১৯ শতাংশ এবং আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির হার ২২ শতাংশ। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার জন্য ২৫ জন প্যানেল আইনজীবী দায়িত্ব পালন করছেন। একইভাবে ঢাকায় ১৩টি বিশেষ জজ আদালতে ১৪ জন পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োজিত আছেন। ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলা আদালতেও একজন করে পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দিয়েছে দুদক। তাদের কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালকরা মনিটরিং করে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে প্রধান কার্যালয় থেকেও তাদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান ও মনিটরিং করা হয়।
মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা জজকোর্টে দায়িত্বরত দুদকের প্যানেল আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আমাদের সময়কে জানান, দুদকের মামলাগুলো বিশেষ আইনে চলে। বিশেষ আদালতে বিচার হয়। সাক্ষী আসলে এবং প্রসিডিউরাল কোনো সমস্যা না থাকলে মামলা নিজস্ব গতিতেই চলে। তিনি আরও বলেন, ‘কোনো কোনো মামলা নানা কারণে নিষ্পত্তি বিলম্ব হয়। তদন্ত শেষ করতে দেরি হলে, সাক্ষী সঠিক সময়ে না আসলে, অথবা আসামিপক্ষ মামলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসলে- এসব কারণে দেরি হয়।’
এক মামলা অন্য মামলার সঙ্গে মিলানো যায় না উল্লেখ করে দুদকের আইনজীবী জাহাঙ্গীর বলেন, ‘কোনো কোনো মামলায় সাক্ষী বেশি থাকে, ওই সব মামলা নিষ্পত্তি হতে দেরি হয়। যেমন ডেসটিনির মামলা, ব্যাংকের বড় বড় দুর্নীতির মামলাগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। যে কারণে সাক্ষী বেশি হয় বলে মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে।’
ছয় হাজারের বেশি বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে দুদকের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রাথমিক অনুসন্ধানে কোনো অভিযোগের সারবত্তা পাওয়া গেলে তারপর নিয়মিত অনুসন্ধান করা হয়। এরপর প্রমাণ মিললে ওই বিষয়ে মামলা করা হয়। মামলা দায়েরের পর পরবর্তীকালে আদালতে চলে যায়। এরপরও আমাদের কর্মকর্তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেন যাতে মামলাটি প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য, তথ্য ও দালিলিক প্রমাণ উপস্থান করা যায়। এতে করে কখনো কোনো মামলা নিষ্পত্তি হতে কিছু সময় বেশি লেগে যায়। আদালতে আমাদের প্যানেল আইনজীবীরা আছেন, তাদের মাধ্যমে সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে তুলে ধরার মাধ্যমে মামলা বিচারকাজ এগিয়ে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। কমিশন থেকে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ আমাদের সময়কে জানান, গত বছর নতুন করে প্রায় ৩শ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে চলতি বছর থেকে অনুসন্ধান ও মামলার তদন্তে গতি আসবে। পুরনো বহু কর্মকর্তাকেও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তাদের ওপর অনুসন্ধান-তদন্তের চাপ কমবে। নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষ করা গেলে মামলা নিষ্পত্তিতেও গতি আসবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন