১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি। সংগ্রামী ছাত্ররা পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে ধর্মঘট, মিছিল ও প্রতিবাদী সভা আহ্বান করে। ছাত্রছাত্রী সমবেত হয়ে বিশাল মিছিল বের করে। মিছিল চানখাঁর পুলের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশের গুলিতে বিদীর্ণ হয় আসাদের বুক। তখনই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গুলিবিদ্ধ আসাদ। আসাদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি। আসাদ একটি আদর্শের নাম। আসাদ শুধু নাম নয়, একটি রক্তাক্ত ইতিহাস। পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, শোষণ-মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অমর হয়ে আছে আসাদের নাম। আসাদ ছিলেন দক্ষ একজন
ছাত্র সংগঠক। আসাদ ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা হল শাখার সভাপতি ছিলেন আসাদ। তার জন্ম নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে। ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী হাট-বাজারে হরতাল আহ্বান করেন। আসাদ শিবপুরের মনোহরদী অঞ্চলে হরতালের দায়িত্ব পালন করেন। এ হরতালের দাবি ছিল দুুুুুুুটি। কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের প্রতিবাদ এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করার শপথ। সেদিন হাতিরদিয়া বাজারে হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনজন কৃষক। আর আহত হন আরও অনেকের সঙ্গে আসাদ। কিন্তু আহত হয়েও থেমে থাকেননি বাংলার এই দামাল ছেলে। আহত অবস্থায় তিনি ঢাকায় আসেন এবং পত্রিকা অফিসে গিয়ে হরতালে পুলিশি তা-ব এবং হত্যার ঘটনার বিবরণ দেন। পরদিন জাতীয় পত্রিকায় শিরোনামসহ ছাপা হয় হাতিরদিয়া বাজারের হত্যাকা-ের ঘটনা। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার ঘরে ঘরে, যা আন্দোলনের বহ্নিশিখা হয়ে জ্বলে ওঠে।
১৯৬৯ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মূলত ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শুরু তখন থেকেই। শুরু হয় উত্তাল সময়। ৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ১১ দফা দাবি ঘোষণা করে সম্মিলিত ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে ১১ দফা বাস্তবায়ন ও ইপিআরের নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি ধর্মঘট ডাকা হয়। আন্দোলন নিষ্ফল করার জন্য মোনায়েম সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায়। পুলিশ বারবার ছত্রভঙ্গ করে দেয় সে মিছিল। কিন্তু ছাত্রদের দমিয়ে রাখে সে শক্তি কোথায়! কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয় মিছিল। চানখাঁরপুলের সেই মিছিলে পুলিশের গুলি ছুড়তে থাকলে সে গুলি লাগে আসাদের বুকে। ছাত্ররা গুলিবিদ্ধ আসাদকে নিয়ে ছুটে যায় ঢাকা মেডিক্যালে। কিন্তু পথেই মারা যায় আসাদ। ছাত্ররা আসাদের লাশ নিয়ে মিছিলের পরিকল্পনা করে। কিন্তু প্রশাসন বাধা দেয়। তারা আসাদের লাশ হস্তান্তর করে তার পরিবারের কাছে। ছাত্রদের হাতে তখন আসাদের রক্ত মাখা শার্ট। সেই শার্টই যেন অনুপ্রেরণা হয়ে জাগিয়ে তোলে ছাত্র- জনতাকে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে আসাদের মৃত্যুর খবর। আসাদের মৃত্যুর খবরে জ্বলে ওঠে দাবানল। আসাদের মৃত্যুর পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ আসাদ হত্যার প্রতিবাদে ২২ ও ২৩ শোক দিবস এবং ২৪ তারিখ প্রতিবাদ দিবস পালন করে। এ কর্মসূচির শেষ দিনটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। আসাদের মৃত্যুর পরই সৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্র শাসনের পতন ঘটে। মোহাম্মদপুরের আইয়ুব গেটের নামফলক ফেলে দিয়ে সেখানে টানিয়ে দেওয়া হয় আসাদের নাম। সেই থেকে আসাদ গেট নাম হয়।
আসাদের রক্তে ভেজা লাল শার্ট বাংলাদেশের বিজয়ের ভিত্তি স্থাপন করে। নরসিংদীর স্কুল শিক্ষক আসাদের বাবার নাম মৌলভী মোহাম্মদ আবু তাহের। তার মায়ের নাম মতিজাহান খাদিজা খাতুন। আসাদের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ জুন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের বুকের রক্ত দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে দিয়েছিল কয়েক ধাপ। বাঙালি জ্বলে উঠেছিল প্রতিবাদের আগুনে। রচিত হয়েছিল কবিতা, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়!’ (কবি- হেলাল হাফিজ)। কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘আসাদের শার্ট।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন