বাংলায় অতি প্রচলিত প্রবাদ ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’। দেশের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার প্রবণতার সঙ্গে প্রবাদটির মিল রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রশাসনের অসহায়ত্বও ফুটে ওঠে। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন সরকারের একজন সচিবকে আক্ষেপ করতে দেখা যায় এই বলে যে ‘আমরা বিশ^াস করব কাকে’। শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে নৈতিকতার অধঃপতন সর্বব্যাপী ছড়িয়ে না পড়লে এমনটা ঘটার কথা নয়। তাদের মতে, প্রশ্নফাঁস রোধ করতে হলে শত ‘বেড়া’ দিয়েও কোনো কাজ হবে না, যদি দায়িত্বশীলদের মধ্যে ‘নৈতিকতা’ না থাকে। এমনকি, কাজে লাগবে না কোনো প্রযুক্তিগত সমাধানও।
সম্প্রতি দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পরীক্ষার কেন্দ্রসচিব থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত সম্পৃক্ততা পেয়েছে তদন্ত দল। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তা সমাজের জন্য ‘নৈতিকতা শূন্যতার’ অশনিসঙ্কেত বলে মনে করেন কেউ কেউ। ওই প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের ওপর
আস্থা হারিয়ে সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, ‘আমরা কাকে বিশ^াস করব। কারণ যে ঘটনাটা ঘটল, এর পরে আর কিছু বলা যাচ্ছে না। মানুষকে বিশ্বাস করে বসে থাকলে তো হবে না।’ তিনি বলেন, ‘যে পদ্ধতিতে এখন প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়- এর চেয়ে আরও ভালো পদ্ধতি দেশ-বিদেশে রয়েছে। সব উপায় আমরা দেখব। সব সময় তো একটা পদ্ধতি কার্যকর থাকে না। বিকল্প চিন্তা আমাদের করতে হবে।’
জানা গেছে, দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কুড়িগ্রামে এসএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ছয়জন ও পলাতক একজনসহ সাত আসামিই জড়িত বলে তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। কমিটি তদন্তকাজ সম্পন্ন করেছে। আগামীকাল রবিবার বা পরের দিন সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করা হবে। এ ছাড়া এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার পলাতক আসামি ওই বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আবু হানিফ ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. কামরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি তদন্ত সম্পন্ন করেছে বলে জানিয়েছে। তারা এখন প্রতিবেদন তৈরি করছে। একই সঙ্গে তদন্ত কমিটি আগামী দিনে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা সুপারিশ আকারে প্রতিবেদনে পেশ করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত কার্যক্রমে পলাতক একজনসহ মোট সাতজন প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ছয়জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। অপর একজন বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে গেছে বলে জানা গেছে। ’
অন্যদিকে, প্রশ্নফাঁস বন্ধের জন্য কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁসের খবর আসার পর থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ আসতে থাকে। তার মধ্যে এক ধরনের বিপন্নবোধ কাজ করে। ধারণা হয়, সবাই পাচ্ছে, আমি কেন পাচ্ছি না? সবাই মনে হয় আমার চেয়ে ভালো ফল করে ফেলবে। এতে সেও আগেভাগে প্রশ্ন পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করে। তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে হলে আগে এর বাজার নষ্ট করতে হবে। তার জন্য কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টানা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করা জরুরি।
প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে ২০১৮ সালে এ সংক্রান্ত সরকারের একটি তদন্ত কমিটিতে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘বর্তমান পদ্ধতিতে প্রশ্ন সরবরাহে যে পরিমাণ মানুষ সম্পৃক্ত হন, সেখানে বিশ্বাসের ওপর কিভাবে ভরসা রাখা যায়? সরকারি পর্যায়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির সেøাগান থাকলেও এক্ষেত্রে সেটি নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে না। সেটি হলে কম্পিউটার, প্রিন্টার, ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে নিরাপদে প্রশ্ন পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব। এতে প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁঁকি কমবে, খরচও কমবে।’
নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন সময়ে এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, ‘পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র ছাপানো শুরু হবে। এ জন্য যতগুলো প্রিন্টার দরকার আমরা রাখব। এতে আগেভাগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে যারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, ছাপানো, কেন্দ্রে পৌঁছানোর কাজগুলো করছেন, তারা এ বিষয়গুলো জানেন। এখন প্রয়োজন বসে একটু ব্রেইন স্টর্মিং করা। নিজেদের সদিচ্ছা না থাকলে এ পদ্ধতিতে যাওয়া সম্ভব না।’
এ প্রসঙ্গে নতুন করে ভাবছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি তপন কুমার সরকার। এ নিয়ে বিকল্প উপায় হিসেবে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের কথাই বলেছেন তিনি। তবে বাস্তবে ‘ডিজিটাল প্রশ্ন সরবরাহ পদ্ধতি’তে কিছু বাধা দেখতে পাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তপন কুমার বলেন, ‘প্রায় চার হাজার কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এর মধ্যে দুর্গম অঞ্চলও রয়েছে। এমন কেন্দ্র আছে, যেখানে বিদ্যুৎ নেই। আবার ইন্টারনেটের গতি কম অনেক এলাকায়। এর সঙ্গে আছে কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহারের বিষয়। তিনি বলেন, ‘এই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রযুক্তির সহায়তা নেবেন যারা, তারাও শিক্ষক বা স্থানীয় সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। অর্থাৎ আমি বলছি যে, প্রযুক্তি দিয়ে আমি নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবছি, কিন্তু সেই প্রযুক্তি পরিচালনা বা ব্যবহার করতে তো আমার ওই মানুষগুলো লাগবে। সুতরাং সংশ্লিষ্টদের ‘নৈতিকতা’ না থাকলে শত বেড়া দিয়ে কোনো লাভ হবে না। তিনি বলেন, এভাবে বেড়ায় ক্ষেত খাওয়া শুরু করলে তা হবে দেশের জন্য অশনিসঙ্কেত। এতে প্রযুক্তিও কাজে আসবে না।’
এর আগে ২০১৮ সালে প্রশ্নফাঁস রোধে টিআইবির সুপারিশ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা ২০১২-এর অস্পষ্টতা দূর করা। এ ছাড়া কোচিংবাণিজ্য বন্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রণোদনাসহ অন্য সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করা। প্রশ্নফাঁস রোধ ও সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে গাইড বইয়ের আদলে প্রকাশিত সহায়ক গ্রন্থাবলি বন্ধেও প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে তদারকি বাড়ানো ও প্রচলিত আইনের অধীনে শাস্তি নিশ্চিত করা। ধাপ কমিয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন, ছাপানো ও বিতরণের কাজটি পরীক্ষামূলকভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা এবং পরবর্তী সময়ে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রশ্নফাঁস নিয়ে গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনসমূহ জনসম্মুখে প্রকাশ এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনাগত যে কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা। প্রশ্নফাঁস রোধে বহুনির্বাচনী প্রশ্নব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে তুলে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। পাবলিক পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে প্রশ্নপত্রের একাধিক সেট রাখা। এসব সুপারিশের আংশিক সরকার বাস্তবায়ন করেছে।
তবে শিক্ষাবিদ ড. মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, প্রশ্নফাঁস যে শুধু শিক্ষার ক্ষতি করছে তা নয়, এটা সামাজিক অবক্ষয়ও তৈরি করছে। ছাত্রজীবনে একজনকে দুর্নীতি শেখানো হচ্ছে, যা সে কর্মজীবনে প্রয়োগ করতে পারে। তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। তা দেখে যেন অন্য কেউ আর সাহস না দেখায়।
উল্লেখ্য, গত ২০ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দিনাজপুর বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ইংরেজি প্রথম পত্র ও ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এরপর ওই কেন্দ্রের সচিব লুৎফর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা স্বীকার করেন। একই সঙ্গে তার কাছে কয়েকদিনের আগাম প্রশ্নপত্র রয়েছে বলে জানান। পরে তার কক্ষ তল্লাশি করে গণিত (আবশ্যিক), উচ্চতর গণিত, কৃষিশিক্ষা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. কামরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান ও রসায়ন পরীক্ষা স্থগিত কর হয়। পরে ২২ সেপ্টেম্বর স্থগিত হওয়া চারটি পরীক্ষার নতুন সময়সূচি ঘোষণা করা হয়।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন কুড়িগ্রামের নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান, ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক আমিনুর রহমান, ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক জোবাইর রহমান, কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম, বাংলা শিক্ষক সোহেল চৌধুরী ও পিয়ন সুজন মিয়া। পলাতক রয়েছেন ওই বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আবু হানিফ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন