বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিদের নিজ দেশে অর্থ পাঠানো সহজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বৈধ চ্যানেলে বিদেশিদের অর্থ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বিদেশিরা বৈধভাবে নিজ দেশে অর্থ পাঠিয়েছেন ৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ৮৭১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বিদেশিদের বৈধভাবে অর্থ প্রেরণের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৩৬ লাখ ডলার বা ৮৭০ কোটি টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৯ কোটি ৩৮ লাখ ডলার বা ৮৭২ কোটি টাকা। তবে বিদেশিরা বৈধভাবে যে পরিমাণ অর্থ পাঠাচ্ছেন, তার কয়েক গুণ বেশি নিচ্ছেন অবৈধভাবে। যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধভাবে বিদেশিদের অর্থপ্রেরণ বাড়ায় প্রতিবছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। তাই বিদেশি কর্মীদের সঠিক ডাটাবেজ তৈরি করে সবাইকে করের আওতায় আনা উচিত। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও এনজিওবিষয়ক ব্যুরো বিদেশি নাগরিকদের দেশে কাজের অনুমতি দেয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিডার কাছ থেকে এ অনুমতি নেওয়া হয়। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে কত বিদেশি নাগরিক বৈধ বা অবৈধভাবে কাজ করছে এবং তারা বছরে কি পরিমাণ অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছেই নেই।
গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, বাংলাদেশে বিদেশি কর্মী নিয়োগে কোনো সমন্বিত ও কার্যকর কৌশলগত নীতিমালা এবং বিদেশি কর্মী নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় বিদেশি কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা এবং অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায় না। সংস্থাটির ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি কর্মীরা সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এসব কর্মী বেতনভাতার নামে বছরে ৩১৫ কোটি ডলার পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিনিময় হারে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে করা ওই গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৪৪টিরও বেশি দেশের নাগরিক বিভিন্ন খাতে কর্মরত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছে- ভারত, চীন, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে বেশি বিদেশি কর্মী কাজ করছে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইলসংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়াশিল্প, চিকিৎসাসেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি কর্মরত রয়েছেন।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, দেশে ঠিক কী পরিমাণ বিদেশি কাজ করছে সেটি বলা মুশকিল। বিডা থেকে যারা ওয়ার্কপারমিট নিয়েছে, শুধু তাদের তথ্যই আমরা দিতে পারব। বেপজা ও বেজা থেকেও ওয়ার্কপারমিট নিয়ে বিদেশিরা কাজ করছেন। এর বাইরে অবৈধ বিদেশি নাগরিকরাও এ দেশে কাজ করছেন। তবে আমরা সব কিছুই শৃঙ্খলার মধ্যে আনার কাজ করছি।
এর আগে বাংলাদেশ অবস্থানরত বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা ও তাদের নিজ দেশে অর্থ পাঠানো নিয়ে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি সমীক্ষা করা হয়। ২০১৭ সালে করা সেই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, দেশে বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি বিদেশি নাগরিক কর্মরত রয়েছেন। প্রতিবছর এসব বিদেশি দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমান ডলারের বিনিময় হারে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর পর ২০১৮ সালে বর্তমান সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, আমাদের দেশে এখন বিপুলসংখ্যক বিদেশি কাজ করছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় দেশের কাজে লাগছে না। আমরা নিজেরাই দক্ষতা অর্জন করতে পারলে তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও গতিশীল করবে।
জানা যায়, দেশ থেকে বিদেশদের অবৈধভাবে অর্থপ্রেরণ ঠেকাতেই গত কয়েক বছর ধরে এ সংক্রান্ত নীতিমালায় শিথিলতা আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর নীতিমালা শিথিল করে বিদেশিদের পুরো আয় নিজ দেশে পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিরা তাদের নিট আয়ে আয়ের ৮০ শতাংশ অর্থ যে কোনো সময় নিজ দেশে পাঠাতে পারেন। বাকি ২০ শতাংশ অর্থও কর পরিশোধের পর নিজ দেশে পাঠানোর সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে বিদেশিরা তাদের নিট আয়ের ৭৫ শতাংশ অর্থ নিজ দেশে পাঠাতে পারতেন। আর বাকি অর্থ চাকরি শেষে একেবারে চলে যাওয়ার সময় নিতে পারতেন। এ নীতিমালায় শিথিলতা আনার পর বিদেশিদের বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে, তবে তা আশানুরুপ নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ বিদেশি কর্মী কাজ করছেন, সে তুলনায় বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণের পরিমাণ খুবই নগণ্য। ফলে আমাদেরও ধারণা, বৈধ চ্যানেলের বাইরেও বিদেশিরা নিজ দেশে অর্থ প্রেরণ করছেন। বিশেষ করে ভারতের নাগরিকদের মধ্যে অবৈধভাবে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা বেশি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন