রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক মানুষকে ধরে নিয়ে গুম করার মত মানবতা বিরোধী অপরাধ অবিলম্বে বন্ধ করে সকল গুমের ঘটনার নিরপেক্ষ পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত দাবী করেছে চারটি দেশি-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন। একই সঙ্গে গুমের শিকার ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে ঘটনার সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবী জানানো হয়েছে। জোরপূর্বক গুমের শিকার মানুষদের স্মরণে আন্তর্জাতিক গুম দিবস-২০২২ এর প্রাক্কালে সোমবার (২৩ মে) এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনষ্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (এএফএডি), ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউমেন রাইটস, মায়ের ডাক ও অধিকার যৌথ বিবৃতিতে এ দাবী জানিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে,”বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই জোরপূর্বক গুম বন্ধ করতে হবে এবং সত্য, ন্যায়বিচার, ক্ষতিপূরণ এবং এই ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই অঙ্গীকার নিশ্চিত করতে হবে”।
বিবৃতিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হওয়া মানুষদের স্মরণ করা হয় এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে নিখোঁজদের পরিবারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করা হয়।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ধারাবাহিক ঘটে চলেছে। বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা- বিশেষ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), এবং পুলিশের গোয়েন্দা শাখা জোরপূর্বক গুমের বেশিরভাগ ঘটনায় জড়িত। জোরপূর্বক গুমের শিকার অধিকাংশই হলেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মী এবং সরকারের বিরুদ্ধে ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে চিহ্নিত।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করে ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা করছে। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনাকারীদের দমন করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুলো জোরপূর্বক গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
অথচ, ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা এই সরকার জোরপূর্বক গুম করাকে বরাবরই অস্বীকার করছে। যদিও জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটেই চলেছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুমের বিষয়ে কাজ করা সংস্থা ডব্লিউজিইআইডি-এর ১২৬তম অধিবেশনের আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জাতিসংঘ যেসব নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা দিয়েছে তাদের বেশিরভাগই আসলে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছে।
এদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন যে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী জোরপূর্বক গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল না। … এবং বাংলাদেশে কেউ জোরপূর্বক গুমের শিকার হয় না।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের বেশ কয়েকজন সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে মানবাধিকার কর্মী এবং জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের ওপর আরও দমনমূলক নিপীড়ন চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এমন অনেক হয়রানির খবর সামনে এসেছে। যার মধ্যে রয়েছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করা। গুমের শিকার পরিবারের অনেক সদস্যকে থানায় ডেকে আনা। এবং কিছু ক্ষেত্রে, অনেক পরিবারকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, পুলিশ, র্যাব এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সও (এনএসআই) রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ফোন করে হুমকি দিচ্ছে। তাদের স্থানীয় এনএসআই অফিসে ডেকে পাঠিয়েছে। এবং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত প্রায় মধ্যরাতে তাদের কর্মস্থল ও বাড়িতে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী হানা দিয়েছে।
বিবৃতিতে এই ধরনের হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শনের নিন্দা জানিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির অবৈধ কাজের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারকে ভয় দেখানো ও হয়রানির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের পদ্ধতির সঙ্গে তাদের সক্রিয়তা ও সহযোগিতার জন্য মানবাধিকার রক্ষাকারী ও জোরপূর্বক গুমের শিকার পরিবারগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ঘটনা বন্ধ করা হোক।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, এসব বিষয়ে ২০১১, ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সাধারণ অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল। যদিও এসব বিষয়ে কোনও উত্তর বাংলাদেশ সরকার দেয়নি। বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে জবাবের অভাব এবং ২০১৩ সালের ১২ই মার্চ এসব বিষয়ে সরকারের সঙ্গে মতবিনিময় করতে জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুমের বিষয়ে কাজ করা সংস্থা ডব্লিউজিইআইডি বাংলাদেশে সফরের অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু, সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। যা জাতিসংঘের মানবাধিকার সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার সাথে অসহযোগিতার সমতুল্য।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ তার ফৌজদারি আইনে জোরপূর্বক গুমের অপরাধকে স্বীকৃতি দেয় না। জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র জোরপূর্বক অন্তর্ধান থেকে সকল ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুমোদনের সুপারিশ পেলেও বাংলাদেশ এখনও অনুমোদনের দিকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, একদিকে সরকার জোরপূর্বক গুমের ঘটনা অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে এ সংক্রান্ত কনভেনশনে যোগ দিতে অনিচ্ছা এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতি বিরাজমান। এতে গুমের মত জঘন্য মানবতা বিরোধী অপরাধে দায়মুক্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, জোরপূর্বক গুম আইসিসি’র রোম সংবিধির ৭ নং অনুচ্ছেদে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন