সড়ক মন্ত্রণালয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে গাড়ি ব্যবহারে পিছিয়ে নেই নন-ক্যাডাররাও। মন্ত্রী ও প্রভাবশালী কর্মকর্তার দপ্তরে কর্মরত ব্যক্তিগত সহকারী, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং সিস্টেম অ্যানালিস্ট পর্যায়ের ক্যাডারবহির্ভূত কর্মকর্তারাও সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য গাড়ি পেয়েছেন। তাদের পেছনে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক গাড়ি ছাড়াও দপ্তর সংস্থা থেকে সরবরাহ করা জিপ গাড়ি জোগান দেওয়া হচ্ছে। এসব গাড়ির চালক, জ্বালানি তেল এবং রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ গচ্চা যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত বিল সিনিয়র কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরে অনুমোদন হচ্ছে। কিন্তু অবস্থা এমন যে, এখানে এই অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার যেন কেউ নেই।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব এটিএম মহিদুল হক প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তা নন। ব্যক্তিগতভাবে তার গাড়ি পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তার নামেও সরকারি একটি পাজেরো গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৮৩৯০) বরাদ্দ আছে। মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুল মতিন হাওলাদারেরও কোনো গাড়ি পাওয়ার বিধান নেই। অথচ তার নামেও বরাদ্দ আছে ক্যারিবীয় পিক-আপ (ঢাকা মেট্রো ঘ- ১১-৩০৫৪)। সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোজাহার উল আলম। তাকে গাড়ি বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু তিনিও পেয়েছেন। ঢাকা মেট্রো ঠ-১১-৭৭৬৭ নম্বরের একটি পিকআপ ব্যবহার করেন মোজাহার। এছাড়া সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের একান্ত সচিবের নামে বরাদ্দ রয়েছে ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৪০৮৩ নম্বরের গাড়িটি। সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট শ্যামল রায় (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-২৮৫০), মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইংয়ের সাবেক একজন কর্মকর্তা (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-১৬২১) এবং সিনিয়র প্রোগ্রামার কাজী আল মামুনের (ঢাকা মেট্রো চ-১৩-২৯২৪) নামেও গাড়ির বরাদ্দ রয়েছে। জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, বিধিবিধান অনুযায়ী এ শ্রেণির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগভাবে পৃথক গাড়ি পাওয়ার সুযোগ নেই। পদ ও কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় তারা বড়জোর মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক মাইক্রোবাস ব্যবহারের সুযোগ পেতে পারেন। যদিও মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো মাইক্রো কেনা কিংবা আউটসোর্সিং করেছে সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব এবং উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের অফিসে আনা-নেওয়ার জন্য। মূলত যুগ্মসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তারা গাড়ি প্রাধিকার কর্মকর্তা হিসাবে বিবেচিত। তবে উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা ৩০ লাখ টাকা ঋণ সুবিধা নিয়ে গাড়ি কিনেছেন, তারা সরকারের আর কোনো গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না। কিন্তু বিশেষ কারণে মন্ত্রণালয় কিংবা মাঠপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা শীর্ষ কর্মকর্তা তার পদের জন্য পূর্ব থেকে বরাদ্দ করা সংশ্লিষ্ট কর্মস্থলের গাড়ি নিয়মিত ব্যবহার করলে তিনি রক্ষণাবেক্ষণ ভাতার অর্ধেক তুলতে পারবেন।
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অন্য অফিসারদের গাড়ি ও জ্বালানিসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কাজের প্রয়োজনে দূরের যাত্রার জন্য কেউ কেউ মন্ত্রণালয়ের গাড়ি ব্যবহার করেন, এটা নিয়মের মধ্যেই পড়ে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘করোনাকালে স্বাভাবিক সময়ের মতো মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তার নামের বিপরীতে গাড়ির জ্বালানি ও ড্রাইভারদের ওভারটাইম তোলা হয়েছে কি না-এমন তথ্য আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে দেখব।’
সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় থেকে যেসব বিল উপস্থাপন করা হয় সেসব বিষয় নিয়ে হিসাবরক্ষণ বিভাগ থেকে প্রশ্ন তোলা হয় না। কেন তারা প্রশ্ন তোলেন না-এখানেই সব উত্তর লুকিয়ে আছে। অথচ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে মহাহিসাবরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) অফিসের দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতিটি পয়সার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না, সেগুলো খতিয়ে দেখা। কিন্তু বাস্তবে এই ধরনের ব্যবস্থা অকার্যকর বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সিএজি অফিসের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এ অফিসের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। শুধু এতটুকু বলব-কোনো কিছু কারও অগোচরে হচ্ছে না। সবাই মিলেমিশে বিধিবহির্ভূত সুবিধা জায়েজ করে নিয়েছে। এমন চিত্র শুধু সড়ক মন্ত্রণালয়ে না, প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অনেক আগে থেকে হয়ে আসছে। এর মধ্যে উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় মাত্রায় বেশি হচ্ছে। কারণ সেখানে প্রকল্প ও বাজেট বেশি, তাই অনিয়ম-দুর্নীতি করার সুযোগও বেশি। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যদি কেউ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, গাড়ি নিয়ে অনেক ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে ঠিক কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা তিনি বলেননি।’ গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে গাড়ি ও জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো নিয়ম মানছে কি না জানতে চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের প্রশাসন শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব লিয়াকত আলী খান স্বাক্ষরিত এক পত্রে কিছু ‘অনাবশ্যক’ গাড়ি ব্যবহার হতো বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। ওই পত্রে এসব অনাবশ্যক গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে জানিয়ে বিভিন্ন কাজের ফিরিস্তি দিয়ে সওজ অধিদপ্তরের বেশকিছু গাড়ি ব্যবহার করা হয় বলেও অবহিত করা হয়। সেই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের প্রাধিকারপ্রাপ্তদের একটি তালিকা পাঠানো হয়।
এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেই তালিকায় থাকা বেশির ভাগ কর্মকর্তা অধিদপ্তরের গাড়ি ব্যবহার করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ির জন্যও ৫০ হাজার টাকা করে তুলেছেন। কিন্তু গাড়ি নগদায়ন নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারি গাড়ি ব্যবহার করলে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ২৫ হাজার টাকার বেশি ভাতা উত্তোলন করা যাবে না।
সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগে কর্মরত একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গাড়ির অপব্যবহার নিয়ে বেশির ভাগ কর্মকর্তা যা করছেন, তা বলার মতো নয়। বিভিন্ন সময় পত্রিকায় রিপোর্ট হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নানা আদেশ-নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সেই তিমিরেই। তিনি বলেন, প্রতিবছর সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়, যা দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের জানার মধ্যে। কিন্তু অনেক সময়ে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কাগজ চালাচালির বাইরে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। যদি কোনো ঘটনার অকাট্য প্রমাণাদি দিয়ে শক্তিশালী গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়, সেক্ষেত্রে কিছুদিন হইচই হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে দুদকও নড়েচড়ে বসে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন