দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ী হওয়া চেয়ারম্যানের সংখ্যা ৮১ জন। এ ছাড়া সাধারণ ওয়ার্ডে ২০৩ জন এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৭৬ জন সদস্য ভোট ছাড়াই জনপ্রতিনিধি হলেন। নির্বাচন কমিশন গতরাতে এ তথ্য জানিয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার এই নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের সংখ্যা বাড়ে।
বরিশালের আগৈলঝাড়ায় প্রতিপক্ষরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর এ উপজেলার পাঁচটি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না। সাধারণ ওয়ার্ড সদস্য এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য পদেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। লাকসামের কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ—প্রার্থিতা প্রত্যাহারে অনেককে বাধ্য করা হয়েছে। এ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের সঙ্গে প্রত্যাহার বাণিজ্যও যোগ হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদর মত। তবে প্রথম ধাপের নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ীদের তুলনায় দ্বিতীয় ধাপে তা কম।
আজ বুধবার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেবেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা। একই সঙ্গে এ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারও শুরু হবে আজ।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের হিসাব অনুসারে এ দফার নির্বাচনে ৩২টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো দলের বা স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেননি। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে একক প্রার্থী আরো একজন বাড়ে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় সেখানে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী। এর ফলে চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী রয়েছেন—এমন ইউপির সংখ্যা ৩৩-এ পৌঁছে যায়।
গতকাল প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে একক প্রার্থীর সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন মোট ৫৭২ জন। সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য পদে ১৯৩ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ডের সদস্য পদে এক হাজার ৬৬৪ প্রার্থী তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এ অবস্থায় ৮৪৬ ইউপিতে বিনা ভোটে জয়ীরা বাদে চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে তিন হাজার ৩১০, সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৯ হাজার ১৬১ এবং সাধারণ ওয়ার্ডে ২৮ হাজার ৭৭৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলেন।
যে ৮১ টি ইউপি বিনা ভোটের চেয়ারম্যান পেতে যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে- সিরাজগঞ্জ সদরের সয়দাবাদ, ছোনগাছা ও সয়দাবাদ, রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া, ধমাইনগর ও ব্রহ্মগাছা; যশোর চৌগাছার ফুলসারা; মাগুরা সদরের হাজরাপুর; বাগেরহাট সদরের গোটাপাড়া, যাত্রাপুর, ষাটগুম্বজ এবং মোল্লাহাটের গাংনী; জামালপুর সদরের রশিদপুর; শেরপুর সদরের কামারেরচর, গাজীর খামার ও পাকুড়িয়া; কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের বলিয়ারদি, হালিমপুর ও মাইজচর; মানিকগঞ্জের সিংগাইরের বায়রা; নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া, গোলাকান্দাইল ও ভুলতা; চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর, মুরাদপুর, কুমিরা, সোনাইছড়ি ও ভাটিয়ারী, মিরসরাইয়ের করেরহাট, ধুম, ওসমানপুর, কাটাছাড়া, মঘাদিয়া, মায়ানী, হাইতকান্দি, ইছাখালী ও ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ; কুমিল্লার লাকসামের কান্দিরপাড়, গোবিন্দপুর, উত্তরদা, আজগরা ও লাকসাম পূর্ব; ফেনীর ফুলগাজীর ফুলগাজী, মুন্সিরহাট ও আনন্দপুর; বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার, বাকাল, বাগধা, গৈলা ও রত্নপুর; ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরখলিফা; মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার রমজানপুর; শরীয়তপুরের সদর উপজেলার চন্দ্রপুর, চিতলিয়া ও বিনোদপুর এবং লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চরলরেন্স।
বরিশালের আগৈলঝাড়ায় দ্বিতীয় ধাপের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি ইউপির সব কটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া অন্যরা সবাই তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
এর আগে এ ধাপে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পাঁচটি ইউপির কোনোটিতেই চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ছাড়া আর কোনো প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেননি। শুধু চেয়ারম্যান পদেই নয়, ওই পাঁচটি ইউনিয়নের সাধারণ সদস্যের ৪৫টি পদের মধ্যে ৪৪টিতে এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্যের ১৫টি পদের সব কটিতে একজনের বেশি প্রার্থী ছিলেন না। গতকাল সাধারণ সদস্য পদের বাকি একটি—উত্তরদা ইউনিয়নের ১ নম্বর সাধারণ ওয়ার্ডে দুজন প্রার্থীর মধ্যে একজন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এর ফলে লাকসাম উপজেলার ওই পাঁচটি ইউপিতে কোনো পদের জন্যই ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের বাইরের প্রার্থীদের অনেকে নানা ধরনের হুমকির কারণে রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেননি বা জমা দিলেও পরে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রত্যাহার বাণিজ্যও চলেছে।
গাজীপুরের কাপাসিয়ায় দুটি ইউপির দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ালে হত্যার হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই দুই চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হলেন রায়েদ ইউনিয়নের আমিনা মুনমুন ও দুর্গাপুর ইউনিয়নের এম এ ওহাব খান খোকা। গত সোমবার রাতে পৃথক দুই জনাকীর্ণ এলাকায় তাঁদের হুমকি দেওয়া হয় মর্মে তাঁরা গতকাল দুপুরে থানায় অভিযোগ করেন।
কাপাসিয়া থানার ওসি এ এফ এম নাসিম এ বিষয়ে বলেন, ‘আলাদা দুটি অভিযোগই পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
হুমকি দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হচ্ছে বলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষেও অভিযোগ রয়েছে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রার্থীদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে, উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করানো হচ্ছে। সারা দেশে এ নিয়ে আমরা এক ধরনের দস্যুতার শিকার। প্রার্থীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে কোথাও কোনো লিখিত অভিযোগ করেছেন কি না—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কার কাছে অভিযোগ করব? যাদের কাছে অভিযোগ করার কথা, তারাই তো ওদের পক্ষে।’
অভিযোগের বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, এ ধরনের ঢালাও মৌখিক অভিযোগ যারা করে, তাদের উচিত নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কোনো অভিযোগের সত্যতা পেলে নির্বাচন কমিশন নিশ্চয় ব্যবস্থা নেবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ এ পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, এ ধরনের নির্বাচন অর্থহীন। নির্বাচনে কে জিতবেন তা আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। এখানে ভোটারদের পছন্দ- অপছন্দের কোনো সুযোগ থাকছে না। সরকারি দলের প্রার্থীদের বাইরে অন্যরা ভাবছেন, কনটেস্ট করে কী লাভ? নির্বাচনের যে চরিত্র থাকা দরকার, তা এখন নেই। বাংলাদেশ এখন সে অবস্থানে নেই।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আপাতত কোনো পথ নেই। অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে সে ধরনের কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
নাগরিক সংগঠন ‘সুজন’ সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা চরম অরাজকতার দিকে যাচ্ছি। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়াতে অনেকে সাহস পাচ্ছেন না। কেউ দাঁড়ালে নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। কোনো সভ্য সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না।’
এর আগে প্রথম ধাপে গত ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ৩৬৪টি ইউপির মধ্যে ৭২ জন চেয়ারম্যান একক প্রার্থী হিসেবেই জনগণের ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছেন।
এ ধাপে ৮৪৬ ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দেয় ৮৩৮ ইউপিতে, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির সাতটি এবং রাঙামাটির বরকল ইউপির বড়হরিণা ইউপিতে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি। এই আটটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে আওয়ামী লীগের ৮৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে বাদ পড়েন ১১ জন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী দেয় ৩৬৮ ইউপিতে, বাছাইয়ে বাদ পড়ে ১০ ইউপি থেকে। জাতীয় পার্টি (জাপা) প্রার্থী দেয় ১০৭ ইউপিতে, বাদ পড়েছে দুই ইউপিতে। জাকের পার্টি প্রার্থী দিয়েছে ৪৯ ইউপিতে, বাদ পড়ে দুই ইউপি থেকে। চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন দুই হাজার ৬৫৫ জন, বাছাইয়ে বাদ পড়েন ৯৯ জন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন