সেতু নির্মাণের কাজ এখনো শেষ হয়নি। সেতুর সঙ্গে সংযোগ সড়কের কাজও অনেকটাই বাকি। এরপরও ঠিকাদারের প্রতি ভীষণ ‘উদার’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। শতভাগ কাজ হয়ে গেছে দেখিয়ে পুরো টাকাই ঠিকাদারকে দিয়েছে করপোরেশন। বাস্তবতা হচ্ছে সেতু ও অ্যাপ্রোচ (সংযোগ) সড়কের কাজ ৮০ ভাগের মতো হয়েছে। এখনো ২০ শতাংশ কাজ বাকি। অথচ সেতু ও সড়ক নির্মাণকাজের জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় ৯ কোটি টাকার পুরোটাই হাতে পেয়ে আর প্রকল্পমুখী হচ্ছে না ঠিকাদার।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে লায়নহাটি সড়কে আবেদ মাস্টার বাড়িসংলগ্ন দেবদোলাই খালের ওপর একটি সেতুর নির্মাণকাজে এমন ঘটনা ঘটেছে। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৩০ মিটার, প্রস্থে ৯.৮ মিটার। সেতুতে ওঠানামা করতে ৩০ মিটার করে ৬০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের কথা রয়েছে। সেতু এবং সেতুতে ওঠানামার জন্য সংযোগ সড়ক তৈরিতে বরাদ্দ প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া সেতুসংলগ্ন এলাকায় সড়ক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল আরও প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। সব মিলিয়ে একটি প্যাকেজের অধীনে কাজটি হচ্ছিল। কাজ শেষ না করলেও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে গত জুন মাসে সব টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কাজ শেষ না করে টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়ে সেতুটি নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এস ভূঁইয়া অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী নুরু ভূঁইয়া প্রথম আলোর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সাংসদ শামসুল হক ভূঁইয়ার ভাগনে নুরু ভূঁইয়া।
গত শুক্রবার দেখা গেছে, সেতুর মূল অবকাঠামোর কাজ শেষ হলেও রেলিংয়ের কাজ এখনো বাকি। সেতুতে ওঠার সংযোগ সড়কের দুই পাশের প্রতিরক্ষাদেয়াল তৈরির কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। সেতু থেকে দুই দিকের সংযোগ সড়কের এক পাশে কিছু বালু ফেলা হয়েছে আরেক পাশে বালু ও দেয়াল নির্মাণের কাজ বাকি। স্থানীয় দুজন বাসিন্দারা বলেছেন, প্রায় এক মাস হলো সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ। সংযোগ সড়কের কাজ অর্ধেকও হয়নি।
বিজ্ঞাপন
প্রকল্প সূত্র বলছে, সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরে। বেঁধে দেওয়া সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু এরপরও বেঁধে দেওয়া সময়ে কাজ শেষ হয়নি। টাকা দেওয়ার পর এখন দ্রুত বাকি কাজ শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দিচ্ছে সিটি করপোরেশন।
কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে পুরো টাকা পরিশোধ করাকে বিধিবর্হিভূত বলছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বেঁধে দেওয়া সময়ে কাজ শেষ করতে না পারাটা প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা। ঠিকভাবে তদারকি না করার কারণে নিয়ম ভেঙে পুরো টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এর দায় প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিরই একাধিক প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেছেন, যে জায়গায় এবং যে আয়তনে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে তার ব্যয় বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী কোনোভাবেই ৩ কোটি টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। অথচ শুধু সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা, এটি অনেক বেশি।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন যুক্ত হওয়া নাসিরাবাদ, দক্ষিণগাঁও, ডেমরা ও মান্ডা—সাবেক এই চারটি ইউনিয়নের অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১৮ সালে ৫১৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পকাজ শুরু হয়। এ প্রকল্পের আওতায় সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদারকে টাকা পরিশোধের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্পের পরিচালক তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি কাজ শেষ না করে তাঁর (ঠিকাদার) তো ১০ শতাংশ সিকিউরিটি মানি জমা আছে। এই ঠিকাদারের মোট ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা করপোরেশনের কাছে জমা আছে।’
আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সেতুর বাকি কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে জানান প্রকল্পের পরিচালক।
ঠিকাদারকে বিল দিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে সুপারিশ করা দক্ষিণ সিটির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকবর হোসেন বলেন, মানবিক কারণে তিনি বিলে সই করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই ভৌত অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ করার পর আর্থিক পাওনা মেটাতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় পুরো টাকা ঠিকাদারকে দিতে হয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, গত মে মাসে এই সেতুর অগ্রগতি প্রতিবেদনে নির্মাণকাজ ৫৩ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে সেতুর ওপরে ঢালাইয়ের কাজ হয়েছে। মূলত ঠিকাদার বিল তুলে নেওয়ার পরই মূল সেতুর ঢালাইয়ের কাজ করেছেন। এরপর আর কোনো কাজ হয়নি।
আইনগতভাবে কাজ শেষ হওয়ার আগে কোনো ঠিকাদারকেই পুরো টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের অযোগ্যতার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন