ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে চা বিক্রেতা আকরামউদ্দিন ঈশ্বর গুপ্তের পাঠকপ্রিয় এ কবিতাটি পড়েছে কিনা জানা নেই। কিন্তু কবিতাটির ঢাকাই সংস্করণ শোনা গেল তার কণ্ঠে, ‘দিনে-রাতে বেশুমার মশা-মাছি, এই নিয়ে ঢাকায় আছি।’
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চির অমলিন চরিত্র শ্রীকান্ত মশার কামড় সহ্য করতে না পেরে সন্ন্যাসগিরিতে ইস্তফা দিয়ে সংসারজীবনে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর ঢাকাবাসী মশার যন্ত্রণায় সংসারজীবন ছেড়ে বুঝি সন্ন্যাসজীবনের সন্ধানে এ শহর ছাড়তে চাইছে। মশার কামড়ে তটস্থ নগরবাসী দিনে যেমনই হোক, রাতে ভীষণ যন্ত্রণায় ভোগেন। রাজধানীর মানুষের মুখে মুখে এখন মশার উৎপাত প্রসঙ্গ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ। বছর বছর রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের বাজেট বাড়লেও মশা কমছে না। চলতি বছর ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার ভাইরাসবাহী মশার উৎপাত কম। তবে গবেষকরা বলছেন অন্য সময়ের তুলনায় রাজধানীতে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে চারগুণ।
২০২০-২১ অর্থবছরে মশক নিধনে দুই সিটির বাজেট ১১২ কোটি টাকা। এর বাইরেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ রয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধনে অর্থের বরাদ্দ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবছর বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বরাদ্দের পাশাপাশি বেড়েছে মশার উৎপাতও।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও ব্যয় হয় ১৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২৬ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছে ১৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছিল ২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ বছর মশক নিয়ন্ত্রণে যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ সাত কোটি টাকা বাজেট ছিল। ব্যয় হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় মশক নিধনে। এর বাইরে মশক নিধন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সাত কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মশক নিধনে বাজেট ছিল ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ব্যয় হয় ১৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২০ কোটি টাকা, ব্যয় হয় ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২১ কোটি টাকা, ব্যয় করা হয় ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ব্যয় করা হয় ৫৮ কোটি টাকা। ওই বছরে যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ খরচ করা হয়েছিল আট কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে মশক নিধনে বাজেট রাখা হয় ৭০ কোটি টাকা।
ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়াসহ ১৩ ধরনের রোগ ছড়িয়ে বেড়ায় এই ঘাতক মশা। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন মশার প্রাদুর্ভাব বেশি। অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, অপরিচ্ছন্নতা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে মশার পরিমাণ এবং প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতাও বেড়েছে বহুগুণ। তাই এখন প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহার করেও মশা কমানো যাচ্ছে না।
সরেজমিন বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক মাস ধরেই রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেড়েছে। বস্তি থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকা- কোথাও রেহাই নেই। সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় মশার উৎপাত। শুধু তাই নয়; দিনের বেলায়ও অনেক বাড়িতে মশারি টাঙিয়ে রাখতে হচ্ছে। মশার যন্ত্রণায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা তো বটেই, নৈমিত্তিক সব কাজেই ব্যাঘাত ঘটছে। বাড়ছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো এডিসবাহিত রোগের ঝুঁকি।
কয়েক মাস আগে মশার উপদ্রব কিছুটা কম ছিল। তখন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়রদ্বয় দাবি করেছিলেন- এ বছর মশা বা মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে। কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় সিটি করপোরেশনের সেই বক্তব্য নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। এমনকি নগর কর্তৃপক্ষের মশক নিধনের ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ একজন কাউন্সিলরও।
মশা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সিটি করপোরেশনের অবহেলা ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকেই দায়ী করছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তারা বলছেন, বছরজুড়ে যেখানে মশা নিধন পরিচালনা করার কথা, সেখানে ডেঙ্গু কমতে থাকার পর দুই সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো কার্যক্রমই ছিল না।
গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আমাদের সময়কে বলেন, দ্রুত এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে ওয়ার্ডগুলোতে জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে ক্রাশ প্রোগাম চালানো দরকার। জরুরি মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে যেসব স্থানে পানি জমে থাকে, ময়লা-আবর্জনা থাকে, এমন সব স্থানে একসঙ্গে লার্ভিসাইডিং করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে প্রতিটি ওয়ার্ডেই একটু জায়গাও যেন বাদ না পড়ে। একদিন বা দুদিনের মধ্যে কাজটি করতে হবে। এর মধ্যেই এডাল্টিসাইডিংও করতে হবে। অর্থাৎ একসঙ্গে ক্রাশ করে দিতে হবে। তা হলেই নিয়ন্ত্রণে আসবে। তিনি বলেন, কেবল সিটি করপোরেশনই নয়, নগরবাসীকেও এগিয়ে আসতে হবে। মশক নিধনে সহায়তা করতে হবে।
দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী আমাদের সময়কে বলেন, মশার ওষুধ আমরা পরীক্ষা করি না। কাজটা করে আইইডিসিআর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের প্লান্ট প্রটেকশন। তারা যে ওষুধের অনুমোদন দেন, আমরা সেটিই ব্যবহার করি। এর পরও আমরা মশার ওষুধের পরিমাণ কিছুটা বাড়াব।
তিনি বলেন, কিউলেক্স মশার পরিমাণ এ সময়টাতে কিছু বাড়ে। আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি, ওষুধের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন ওষুধও যুক্ত করব।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজাও মশা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, মশা বেড়েছে সত্য। তবে বিগত সময়ে আমরা কয়েকবার চিরুনি অভিযান করেছি। এখনো বিশেষ অভিযান চলছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন