আগুনে পুড়ে যাওয়া রাজধানীর মহাখালী সাততলা বস্তি লাগোয়া দোকানে মাথায় হাত দিয়ে বসে আহাজারি করছিলেন ফিরোজা বেগম। মধ্যবয়সী এই নারীকে ঘিরে আরো অনেকে। গত সোমবার রাতের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এনজিও থাইক্যা লোন কইরা দোহানে ৫০ হাজার টাকার মাল উডাইছিলাম। পুইড়া সব শ্যাষ। এহন কী কইরা খামু, গরিবের এত বড় ক্ষতি ক্যাডা করলো, ক্যাডায় বস্তিতে আগুন লাগাইলো। আগুন কেউ লাগাই দিছে।’
সরেজমিনে গতকাল মঙ্গলবার সাততলা বস্তিতে গিয়ে এমন অনেকের আহাজারি চোখে পড়ে। বস্তিবাসী ইসলাম উদ্দিনসহ আরো কয়েকজন মুরব্বি বলেন, ‘প্রতিবছর শীত আইলেই বস্তিতে আগুন লাগে। গত পাঁচ বছরে ছয়বার বস্তিতে ছোট-বড় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ আগুনই পরিকল্পনা কইরা লাগানো। হেরা আমাগো বস্তি থাইক্যা সরানোর লাইগ্যা আগুন দেয়।’
দুপুর থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বস্তি ঘুরে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে সব এলোমেলো। নারী, শিশু, বৃদ্ধ এক কাতারে। মলিন চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে সবাই। পাশাপাশি ছাই, পোড়া কাঠ, বাঁশ আর টিন সরিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধার চেষ্টাও চলছে। মাইকে জানানো হচ্ছে, ‘এখানে ভিড় না করে যাঁরা বাইরে থেকে এসেছেন তাঁরা চলে যান। সবাই মাস্ক পরুন।’ তবে বেশির ভাগ লোকের মুখে কোনো মাস্ক দেখা যায়নি।
পাশেই সেবামূলক কাজ করছিল বিভিন্ন এনজিও। ব্র্যাককর্মী শিরিন শিলা জানালেন, আগুনে বস্তির অনেক ঘর পুড়েছে। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে বস্তিবাসীকে হাঁড়ি-পাতিলসহ রান্নার সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।
এর মধ্যেই চোখে পড়ে, মাস্ক পরা এক ব্যক্তি বস্তির লোকজনকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দেওয়ায় তৎপর। কাছে গিয়ে জানা গেল, তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাসির। তিনি বললেন, আগুনে বস্তির ১২৭টি ঘরের পাশাপাশি দোকান পুড়েছে ৩৫টি। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক। তবে দোকানদারদের বেশি ক্ষতি হয়েছে। কারণ তাঁদের দোকানের ফ্রিজ, টেলিভিশনসহ নগদ টাকা ও অন্যান্য সরঞ্জাম পুড়ে গেছে।
আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কাউন্সিলর নাসির বলেন, ‘ঘটনার পরপরই লোকজন নিয়ে বস্তিতে এসে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছি। বস্তির লোকজন আমাদের জানিয়েছে, ফ্রিজের কম্প্রেসার বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত। তবে প্রকৃতপক্ষে আগুন লাগার কারণ খতিয়ে দেখছে ফায়ার সার্ভিস।’
বস্তির ৭০ বছর বয়সী ইসলাম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি ২৫ বছর ধরে এই বস্তিতে আছেন। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে এখানে ছয়বার আগুন লেগেছে। আগুন লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেমনে কমু? তয় কেউ কয় আগুন লাগানো হয়, আবার হুনি বৈদ্যুতিক তার থাইক্যা আগুন লাগে। কোনটা বিশ্বাস করুম বুঝতে পারি না।’
গত সোমবার রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে সাততলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে বস্তির ১২৭টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের কেউ দোকানদার, কেউ রিকশাচালক, কেউ বা সবজি বিক্রেতা। এখানকার বাসিন্দা নারীদের বেশির ভাগ বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করেন। গার্মেন্টকর্মীরাও থাকেন এখানে। আগুনে কমবেশি তাঁদের প্রায় অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট পাঠানো হয়। পরে আরো ইউনিট যোগ করা হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১২টি ইউনিট কাজ করে। তবে সরু পথ ও পানির উৎসর অভাবে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে। আগুনে কেউ হতাহত হওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কালের কণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন