অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধানের নামে প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল শাখার একটি সেভিংস অ্যাকাউন্টে ৬১ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক। ১১ মাসে এ অর্থ লেনদেন হয়। উৎসবিহীন এ অর্থের প্রায় পুরোটাই থাইল্যান্ডে পাচার করা হয়েছে। যা মানি লন্ডারিং ধারায় সরাসরি অপরাধ। এ অর্থ অনলাইন ক্যাসিনো থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
দুদক সূত্র জানায়, সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও অর্থ পাচারের অভিযোগে শিগগিরই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে। তার বিরুদ্ধে আরও অন্তত ১৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে। যদিও গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে ১৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মামলা করেছিল দুদক। তবে তদন্তে বেরিয়ে আসছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। মামলাটি তদন্ত করছেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান।
সূত্র আরও জানায়, সেলিম প্রধানের ক্যাসিনোর রেকর্ডপত্র সংগ্রহে এবার এমএলএআর পাঠানো হল যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাসে সেলিম প্রধানের ক্যাসিনো খেলা এবং সেখান থেকে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে ক্যাসিনো চিপস এবং ক্যাসিনো যন্ত্রপাতি ক্রয় করার তথ্য পাওয়া গেছে।
কে এ সেলিম প্রধান? কেনই বা তাকে অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট বলা হয়। তদন্তে তারও বিবরণ উঠে এসেছে। সেলিম প্রধান নারায়ণগঞ্জে জন্মগ্রহণ করলেও বেড়ে উঠেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে। খুব অল্প বয়সে তিনি জাপানে যান। সেখানে টানা ৯ বছর থাকার পর ব্যবসায়িক ঝামেলার কারণে তাকে জাপান ছাড়তে হয়। এরপর তার যাত্রা আমেরিকার নিউইয়র্কে। সেখানেই মূলত অনলাইন ক্যাসিনো খেলার হাতেখড়ি হয় তার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তার বেশিদিন থাকা হল না। চুরির অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার হন তিনি। পরে ছাড়া পেয়ে আবার জালিয়াতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। জাল-জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে ২০০৫ সালে আমেরিকার আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
অপরদিকে জেপি মরগান চেসব্যাংকে সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। লাসভেগাসের মন্টি কার্লো রিসোর্টে গিয়ে সেলিম প্রধান নিয়মিত ক্যাসিনো খেলতেন। ওই রিসোর্ট থেকে তার ক্যাসিনো চিপস ক্রয়ের রেকর্ডপত্র এখন দুদকের হাতে। মামলা প্রমাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ডপত্র সংগ্রহের জন্য এমএলএআর পাঠিয়েছে দুদক।
বাংলাদেশে মূলত কোরিয়ান ব্যবসায়িক পার্টনারের মাধ্যমে সেলিম প্রধান অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি গুলশানে প্রধান স্পা সেন্টার, প্রধান টেক্সটাইলসহ ছোটখাটো কিছু ব্যবসা শুরু করেছিলেন। মূলত ক্যাসিনো ব্যবসাকে আড়াল করতেই অন্য ব্যবসা শুরু করেন তিনি। একই বিল্ডিংয়ের উপরের তলায় অফিস ছিল সেলিম প্রধানের। আর নিচ তলায় তার কর্মচারী ও কোরিয়ার পার্টনারের সহায়তায় অনলাইন ক্যাসিনো শুরু করেন। তিনি অল্প শিক্ষিত হলেও দেশের বাইরে অনেক বছর থাকার ফলে তার মধ্যে ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া। সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে ছিল তার চলাফেরা। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন সেলিম প্রধান। ১২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার তদন্তকালে সেলিম প্রধানের বাংলাদেশের প্রায় অর্ধশত ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। দেশের ৭৬টি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের পত্র দিয়ে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। সেলিম প্রধানের আয়কর নথি জব্দ করেছে দুদক। গ্রেফতারের সময় তার সঙ্গে থাকা বিদেশি অর্থেরও ফিরিস্তি করা হয়েছে। এছাড়া, বিদেশে সেলিম প্রধানের কি কি সম্পদ রয়েছে, তার তথ্য সংগ্রহের জন্য জাপান, থাইল্যান্ড ও আমেরিকা, সিঙ্গাপুরে পত্র দিয়েছিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে সেলিম প্রধানের থাইল্যান্ড ও আমেরিকার তথ্য পেয়েছে দুদক। সেলিম প্রধানের থাইল্যান্ডে প্রধান গ্লোবাল ট্রেডিং, এশিয়া ইউনাইটেড এন্টারটেইনমেন্ট লি., তমা হোম পাতায়া কোং লি. নামীয় সাতটি কোম্পানির রেকর্ডপত্র এখন দুদকের হাতে। থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ব্যাংক ও দ্য সায়েম কমার্শিয়াল ব্যাংকে সেলিম প্রধানের ২০ কোটি টাকারও বেশি অবৈধ লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক। এছাড়া, থাইল্যান্ডে সেলিম প্রধানের বিভিন্ন কোম্পানিতে মো. আশিক আহমেদ, এসএস হোসাইন নামীয় দু’জন বাংলাদেশি পার্টনারের যুক্ত থাকার তথ্য পেয়েছে দুদক। তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান ইতোমধ্যে থাইল্যান্ডের সেলিম প্রধানের ব্যাংক হিসাব ও কোম্পানির রেকর্ডপত্র জব্দের নিমিত্তে এমএলএআর (পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি) করেছেন। অপরদিকে, সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে অনলাইন ক্যাসিনো খেলার প্রমাণ পেয়েছে দুদক এবং অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে সেলিম প্রধান প্রায় ১৩ কোটি টাকা উপার্জন করে তা পাচার করেছেন বলে দুদক প্রমাণ পেয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন