এতিমদের তার ‘অত্যন্ত কাছের’ ও ‘আপনজন’ আখ্যায়িত করে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- ‘তোমরা অনাথ কিংবা অসহায় নও, তোমরা আমার অত্যন্ত কাছের এবং আপনজন। যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন আমি তোমাদের পাশে আছি। তোমাদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করাই আমার সব সময়ের প্রচেষ্টা।’ অথচ সেই এতিমদেরই নড়াইল পুলিশ বলছে- ‘তোরা গাঁজা ও ফেনসিডিলখোর, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হবি। কখনো মানুষ হতে পারবি না। ছোট থেকে বড়, সবাই তোরা খারাপ।’ এমনটাই অভিযোগ করেছে নড়াইল সরকারি শিশু পরিবারের এতিম নিবাসীরা।
শিশু পরিবারের নিবাসী শিশুদের দাবি, সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সোহান সিকদার ১০-১২ দিন ধরেই গলা ব্যথা ও সর্দি-কাশিতে ভুগছে। অথচ তাকে কেবল নাপা ট্যাবলেট আর একটি কাশির সিরাপ খেতে দেওয়া হয়েছে। এতে তার শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তনই হচ্ছে না। সিরাপ খেলে মাথা ঘোরায়। এর মধ্যে গত রবিবার রাতে সোহানের অবস্থা আরও খারাপ হলে বন্ধুরা জরুরি চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নিতে চায়। কিন্তু গেট বন্ধ থাকায় ডাকাডাকি করে কাউকে না পেয়ে কাচের জানালার ফাঁক গলে কেউ কেউ নিচে নেমে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানায়। অসুস্থ সোহানের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বললে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু রাত ২টার দিকে কর্তৃপক্ষ দুই পুলিশ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কান ধরায় এবং চড়থাপ্পড় মারে। হইচই ও শব্দ করা এবং চেয়ার-টেবিল ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে। পুলিশ সদস্যরা তখন সবার সঙ্গেই খুব বাজে আচরণ ও গালাগালি করেন। শিশুরা অবশ্য বলছে, তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার কিছুই তারা ওই রাতে করেনি। অসুস্থ বন্ধুর চিকিৎসার দাবি জানিয়েছে কেবল।
এ ঘটনায় গতকাল সোমবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করে নড়াইল সরকারি শিশু পরিবারের এতিম নিবাসীরা। পরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এক বৈঠক হয়। জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা বলেন, ‘শিশুরা তাদের কিছু সমস্যার কথা জানিয়েছে। শিশু পরিবারের শিশু এবং কর্তৃপক্ষ নিয়ে সোমবার বসাবসি করেছি। দুপক্ষের কাছ থেকে বিভিন্ন অভিযোগ শোনা হয়েছে। কীভাবে এর সুষ্ঠু সমাধান করা যায় সেটা দেখছি।’
শিশুরা আরও জানায়, প্রায়ই তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করে কর্তৃপক্ষ। কিছু হলেই নাম কেটে দেওয়ার ভয় দেখায়। মৈত্রী ম-ল নামে এক কারিগরি প্রশিক্ষক প্রায়ই তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বিস্কুট, মুড়ি, চানাচুর নিয়ে যান। উপ-তত্ত্বাবধায়কও মাঝে মাঝে তাদের দিয়ে ঘরের মেঝে পরিষ্কার ও ময়লা ফেলান। ডরমেটরিতে ৩০টি ফ্যানের মধ্যে সাতটিই অকেজো। অনেকগুলো আবার খুব ধীরে ঘোরে। পানির জগ নেই, গ্লাস নেই। দুপুরের রান্না করা খাবার খেতে দেওয়া হয়। ফলে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। এর প্রতিবাদ করলেই শুরু হয় অত্যাচার। নিবাসের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সৌরভ মোল্যা জানায়, মাসখানেক ধরে তার ডান হাতে চুলকানি-অ্যাকজিমা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এর জন্য ঠিকমতো ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না।
সরকারি শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক আসাদুল্লাহ অবশ্য শিশুদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, ‘আমরা ওদের সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই মূলত তারা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেছে। তাদের কিছুদিন খেলতে ও সাঁতার কাটতে না দেওয়ার কারণে এটি হতে পারে।’ তিনি উল্টো অভিযোগ করেন, ‘রবিবার রাতে নিবাসীরা লাঠি নিয়ে নিচে নেমে আসে আমাকে মারার জন্য। পরে রাতেই সমাজসেবা উপপরিচালকের অনুমতি নিয়ে পুলিশ এনে তাদের বুঝিয়েছি। তবে কোনো মারধর করা হয়নি।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক রতন হালদার বলেন, ‘শিশুরা একটু উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেছে। রবিবার রাতে তারা ডরমেটরির চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করেছে। ফলে ব্যাপক শব্দ হয়। টহল পুলিশ ওই শব্দ পেয়েই আমাদের অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু কাউকে মারধর করেনি।’ তাদের দিয়ে কাজ করানো, খেলতে না দেওয়া, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের কথাও অস্বীকার করেন তিনি। এ ছাড়া ফ্যান নষ্ট বা পোশাক না পাওয়া, জগ-গ্লাসসহ বিভিন্ন দ্রব্য না থাকার বিষয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা বরাদ্দের বাইরে তো কিছু দিতে পারি না। তার পরও এসব ঘটনায় একটি তদন্ত দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন