দেশের অন্যতম দুগ্ধপ্রধান ও গো-খামার অধ্যুষিত এলাকা পাবনায় প্রতিদিন অন্তত এক কোটি টাকার জৈব সার গোবর চুলার জ্বালানিতে ছাই হয়ে যাচ্ছে। জৈব সারের মূল্যমান হিসেবে এ টাকার পরিমাণ আরও বেশি। কৃষি বিভাগের উদাসীনতা ও সচেতনতার অভাবে কৃষাণীরা মূল্যবান গোবরকে ঘষি-ঘুটে বানিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহার করছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, পাবনার বিভিন্ন উপজেলা বিশেষ করে নিচু এলাকায় গোবর দিয়ে জ্বালানি তৈরির প্রবণতা প্রবল। ঢাকা-পাবনা মহাসড়কের পাশে বেড়া উপজেলার বিভিন্ন মহল্লায় মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়কের পাশে প্রতিদিন গোবর শুকাতে দেয়া হয়। এছাড়া জেলার বাথান এলাকাগুলোতে থাকা গরুর গোবরও শুকাতে দেয়া হয়। পরে তা জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করা হয়। এভাবে জেলাজুড়ে সিংহভাগ গোবর চলে যাচ্ছে জ্বালানি তৈরিতে। কিছু সংখ্যক চাষি গোবর দিয়ে জৈব সার তৈরি করে।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জৈব সার সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে কৃষকেরা ফসলি জমিতে জৈব সারের পরিবর্তে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করছে। এতে একদিকে রাসায়নিক সার আমদানিতে প্রতি বছর সরকারকে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ভর্তূকি দিতে হচ্ছে।
অন্যদিকে ফসলি জমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগে দিন দিন জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে। ফলে সরকার ও কৃষক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ গো-সম্পদ সমৃদ্ধ জনপদ পাবনা থেকে প্রতিদিনে সংগৃহিত গোবর যদি জ্বালানি হিসেবে (স্থানীয় ভাষায় ঘষি) ব্যবহার না করে ফসলি জমিতে প্রয়োগ করা হতো তাহলে কৃষকের ফসলের উৎপাদন ব্যয় কমে যেত। ফসলি জমির ঊর্বর শক্ষি বৃদ্ধি পেত ও সরকার প্রদত্ত রাসায়নিক সারে ভর্তূকির পরিমাণ কমে যেত।
পাবনা জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলায় গবাদি পশুর (গরু ও মহিষ) মোট সংখ্যা ৪ লাখ ৭০ হাজার।
গো-খামারিরা জানায়, পরিণত বয়সে একটি উন্নতজাতের গরু থেকে দিনে প্রায় ১০ কেজি থেকে ২০ কেজি গোবর পাওয়া যায়। সেই হিসেবে পাবনা জেলা থেকে প্রতিদিন অর্ধকোটি কেজির বেশি গোবর (প্রতি গরু- মহিষ ১০ কেজি গোবর হিসেবে) পাওয়া যায়। তবে এর সিংহভাগই কেবল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
কয়েকজন ঘুটে বা ঘষি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি পরিণত বয়সের গরু থেকে প্রতি দু’দিনে যে পরিমাণ গোবর পাওয়া যায় তা দিয়ে প্রায় অর্ধেক বস্তা জ্বালানি (স্থানীয় ভাষায় ঘষি) তৈরি হচ্ছে। প্রত্যেক বস্তা জ্বালানি বা ‘ঘষি’ এ অঞ্চলে একশ বিশ টাকা থেকে একশ ষাট টাকায় বিক্রি হয়। সেই হিসেবে পাবনা জেলাজুড়ে প্রতি দু’দিনে দু’লাখ ৩৫ হাজার বস্তা ঘষি পাওয়া যাচ্ছে।
৩৫ হাজার বস্তা গোবর সার হিসেবে বাদ দিলেও প্রতি দু’দিনে দু’লাখ বস্তা ঘষি (বস্তা প্রতি একশ টাকা ধরলে) বা দু’কোটি কোটি টাকার জৈব সার যাচ্ছে চুলায়। অর্থাৎ প্রতিদিন এক কোটি টাকা বাজার দরের জৈব সার গোবর বিনষ্ট হচ্ছে। জৈব সার এর দাম হিসেবে এ গোবর এর দাম আরও কয়েকগুন বলে কৃৃষি কর্মকর্তারা জানান।
কৃষি তথ্য সার্ভিস পাবনার সহকারী তথ্য অফিসার (এ.আই.সি.ও) জুলফিকার আলী জানান, ব্রি-বোরো ধান চাষের সময় কৃষকেরা অধিক ফলনের আশায় অতিমাত্রায় ইউরিয়া সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করছে। ফলে জমির উর্বরাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে।
কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কমাতে সরকার ভর্তূকি মূল্যে সার বিক্রি করছে। অথচ উন্নতমানের জৈব সার হিসেবে বিবেচিত গোবর সার জমিতে প্রয়োগ করলে কৃষকের ব্যয় হ্রাস, ফসলি জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি, ফসলি জমি থেকে প্রাপ্ত খাদ্যশস্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধি ও সরকারের সারে ভর্তূকি কমে যেত।
দোতলা কৃষির উদ্ভাবক পাবনার কৃষিবিদ জাফর সাদেক বলেন, উন্নত বিশ্বের ফসলি জমিতে জৈব সারের প্রয়োগের হার ৪ থেকে ৫ ভাগ থাকলেও আমাদের দেশে বর্তমানে তা ২ ভাগেরও নিচে নেমে এসেছে। জমিতে বিভিন্ন ধরনের সুষম রাসায়নিক সার অতিমাত্রায় ব্যবহারে জমিতে ‘পিএইচ’ এর মাত্রা স্বাভাবিক থাকছে না। ফলে কৃষি জমিতে উর্বরা শক্তি অতীতের তুলনায় বহুলাংশে হ্রাস পাচ্ছে। উৎপাদিত ফসলের পুষ্টিমানও কমেছে।
ঈশ্বরদীর খ্যাতিমান কৃষক ও বাংলাদেশ ফার্মার্স এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আলহাজ শাহজাহান আলী বাদশা জানান, দুগ্ধ উৎপাদন প্রধান এলাকা পাবনায় দিনে ৫০ লাখ কেজি গোবর নির্দিষ্ট সময় শেডযুক্ত গর্তে ফেলে রেখে পুরোপুরি পচিয়ে উন্নতমানের জৈব সার হিসেবে ফসলি জমিতে প্রয়োগ করা হলে সর্বক্ষেত্রে এর সুফল পাওয়া সম্ভব। একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যয় কমবে, অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় থাকার পাশাপাশি জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পাবে ও ফসল উৎপাদন বেড়ে যাবে। তবে এ ব্যাপারে কৃষি কর্মকর্তাদের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে বলে তিনি জানান।
পাবনা সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. আকসাদ আল মাসুর আনন জানান, ফসলি জমিতে রাসায়নিক সারের অতিমাত্রায় প্রয়োগের জন্য জনসাধারণ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর পাবনার উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আজাহার আলী বলেন, ফসলি জমিতে জৈব সার প্রয়োগের ফলে জমিতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। কিন্তু অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগে ফসলি জমিতে উর্বরা শক্তি হ্রাস পায়। এ অবস্থা নিরসনে কৃষি বিভাগের জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি শীর্ষক একটি বিশেষ প্রকল্প চলছে। এছাড়া চাষিদের উদ্ধুদ্ধ ও সচেতন করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন