পঞ্চাশের দশকে ঢাকা থেকে রংপুর অঞ্চলে এলেই রংপুর জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় উঠতেন বঙ্গবন্ধু। অন্তত ১০ থেকে ১৫ বার এখানে রাত্রিযাপন করেছেন তিনি। সেই ইতিহাসের এখনো সাক্ষী সেই সময়ের গাড়িচালক ময়েজ উদ্দিন।
ময়েজ উদ্দিনই বঙ্গবন্ধুকে গাড়িতে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। একেবারে কাছ থেকে দেখা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন বয়সের ভারে ন্যুজ ময়েজ।
শেষবার বঙ্গবন্ধু রংপুরে এসেছিলেন স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। খবর পেয়ে ময়েজ উদ্দিন সার্কিট হাউজে দেখা করতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। হঠাৎ দেখা হয় তৎকালীন মন্ত্রী রংপুরের কৃতি সন্তান প্রয়াত মতিউর রহমানের সঙ্গে। তাঁকে বলার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন।
বঙ্গবন্ধু ময়েজ উদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কুশলাদি জানতে চান। তাঁকে কেক খাওয়ান। পরে বঙ্গবন্ধু ময়েজ উদ্দিনের হাতে ৫০ টাকা দিয়ে বলেন, পরেরবার আসলে অনেক কথা হবে। এনডিসিকে বলে তাঁকে গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু পরে আর আসা হয়নি তাঁর। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে। ফলে ওই দেখাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা ছিল ময়েজ উদ্দিনের।
রংপুর জেলা পরিষদ ডাক বাংলোর ১০১ নম্বর কক্ষে উঠতেন বঙ্গবন্ধু। আর গাড়িচালক ময়েজ উদ্দিনকে রাখতেন সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন ৮৫ বছর বয়সী ময়েজ উদ্দিন। বলেন, 'বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। এমন ভালো মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। দেশকে নিয়ে ভাবনাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।'
তৎকালীন রংপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুসলিম লীগ নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়ার জিপগাড়ির চালক ছিলেন ময়েজ উদ্দিন। রংপুর নগরীর রাধাবল্লভ এলাকায় দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে ছেলে-মেয়েসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করছেন যাদু মিয়ার বাড়িতে। দীর্ঘ দিনেও তাঁর নিজের বাড়ি করে থাকা হয়নি। তিনি জানান, কোনো কারণে বঙ্গবন্ধু যাদু মিয়ার উপকার করেছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল বঙ্গবন্ধুর। তবে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে স্বাধীনতার আগেই সম্পর্কে ফাটল ধরে।
স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ছলছল চোখে ময়েজ উদ্দিন বলেন, 'বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে ট্রেনে দুপুরে রংপুরে আসতেন। ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা মেইলের ফার্স্ট ক্লাসে রংপুর স্টেশনে আসেন। তাঁকে আমি চাচা বলে ডাকতাম। মশিউর রহমান যাদু মিয়ার একটি হুডছাড়া জিপগাড়ি (নম্বর-৭৭৭) নিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুকে আনতে স্টেশনে যাই। হ্যান্ডেল মেরে গাড়ি স্টার্ট দিতে হত। স্টেশনে আসার পর অমি চিৎকার করে চাচা চাচা বলে ডাকতাম। বঙ্গবন্ধু কাছে এলে তাঁর হাতে থাকা ছোট ব্যাগটি আমি হাতে নেই। পরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর ১০১ নম্বর রুমে পৌঁছে দেই।'
ময়েজ উদ্দিন জানান, কক্ষে ওঠার পর বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম নেবেন বলে তাঁকে বিদায় করে দিতে চাইতেন। কিন্তু তিনি না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাপড় ধুয়ে রেলিংয়ে শুকাতে দিতেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কক্ষের সামনের চেয়ারে বসতেন আর তিনি কাছে মেঝেতে বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন, তাঁর কথা শুনতেন। বিকেলে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী ময়েজ উদ্দিন রংপুর স্টেশন এলাকায় যাদু মিয়ার লালবাড়ি, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সুধির শংকরের বাড়ি, তাজহাট রাজবাড়ি, জররেজ মিয়ার (একাত্তরে শহীদ) বাসায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতেন।
একদিনের এক ঘটনার কথা মনে করে ময়েজ উদ্দিন বলেন, 'জররেজ মিয়ার বাড়িতে যাওয়ার পথে জিপ স্টার্ট নিচ্ছিল না। আমি চাচাকে (বঙ্গবন্ধুকে) বললাম, চাচা আপনি এক্সেলেটার ধরেন। আমি হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট দেই। কিছুক্ষণ পর জিপ স্টার্ট নেওয়ার পর জররেজ মিয়ার বাসায় পৌঁছই। বঙ্গবন্ধু যতবারই রংপুরে এসেছেন আমি জিপগাড়িতে করে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রতিবারই তিনি আমাকে পাঁচ টাকা বকশিস দিতেন।
বৃদ্ধ ময়েজ উদ্দিন বলেন, আমার শেষ ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।
রংপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, জেলা পরিষদের পুরনো ডাকবাংলোর ১০১ নম্বর কক্ষে বঙ্গবন্ধু অনেকবার থেকেছেন। বিষয়টি আমরা এতদিন জানতাম না। এখন এটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত কক্ষটি অবশ্যই সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন