চাঞ্চল্যকর সুজন হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর পর রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মো. ফজলু ওরফে কুটিকে (৪২) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত রবিবার দিবাগত গভীর রাতে রাজধানীর মুগদা থানাধীন জান্নাতবাগ এলাকা হতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে মামলাটি প্রথমে সবুজবাগ থানা পুলিশ ও পরবর্তীতে ডিবি ডিএমপি ঢাকা কর্তৃক দীর্ঘ প্রায় সাত বছর তদন্ত করেও প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করতে পারেনি। অবশেষে পিবিআই হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন করল।
পিবিআই এর ভাষ্য, সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদের জের ধরে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয় সুজনকে। খুনে অংশ নেয় সাবেক স্ত্রীর প্রেমিকও।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৪ মার্চ মো. আবদুল মান্নানের মেজ ছেলে সুজন তার বন্ধু কুটির সঙ্গে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকার বাসা থেকে বের হয় আর ফিরে আসেনি। এরপর হতে তিনি নিখোঁজ ছেলের খোঁজ করতে থাকেন। পরে ১৮ মার্চ দুপুরে সবুজবাগ থানাধীন দক্ষিণ রাজারবাগ বাগপাড়া এলাকায় খালের কচুরিপানার মধ্যে ভাসমান অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে সুজনের লাশ।
মঙ্গলবার পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইউনিট ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ ওসমান গণি স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সুজন গ্রিলের মিস্ত্রির কাজ করতেন। ২০০৮ সালে সুজন ইভাকে বিয়ে করেন এবং ২০০৯ সালে সুজনের স্ত্রী সুজনকে ডিভোর্স দেন।
তালাক দিলেও ভিকটিম সুজন ইভার বাড়ির আশপাশে যাওয়া-আসা করতেন। ইভার প্রেমিক ফাইজুলসহ ইভার ভাই আরিফ সুজনকে ঘটনাক্রমে দু-একবার মারধরও করেছিল। ওই ঘটনার জের ধরে তার ছেলেকে হত্যা করা হতে পারে সন্দেহ করেন।
পরে ভিকটিমের বাবা আবদুল মান্নান বাদী হয়ে সবুজবাগ থানার মামলা দায়ের করেন। মামলাটি প্রথমে সবুজবাগ থানা পুলিশ ও পরবর্তীতে ডিবি ডিএমপি ঢাকা কর্তৃক দীর্ঘ প্রায় সাত বছর তদন্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
তবুও ঘটনার প্রকৃত রহস্য ও ঘটনায় জড়িত অভিযুক্ত পলাতক আসামি আছমা আক্তার ইভা, মো. আরিফুল হক ওরফে আরিফ ওরফে মো. রানা ওরফে বাবু গ্রেপ্তার না হওয়ায় এবং পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ওই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে ভিকটিমের বাবা না-রাজি আবেদন করেন। আদালত পিবিআইকে মামলাটি তদন্ত করার নির্দেশ দেন। পরে মামলাটির তদন্ত তদারককারী অফিসার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ওসমান গণির নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম অভিযান পরিচালনা করে সুজন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত অন্যতম আসামি মো. ফজলু ওরফে কুটিকে গ্রেপ্তার করে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) কর্তৃক ইতোপূর্বে পলাতক আসামি ইভা, আরিফ ও বাবুকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে আসামি আরিফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজেকে জড়িয়ে সহযোগী আসামিদের নাম উল্লেখ করে বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছিল।
আটক আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআই জানতে পারে, ২০০৮ সালে ভিকটিম সুজনের সঙ্গে ইভার বিয়ে হয় এবং ২০০৯ সালে ইভা সুজনকে ডিভোর্স দেন। সুজন ইভাকে খুব ভালোবাসতেন। ডিভোর্স দেওয়ার পরও সুজন প্রায় সময় ইভাকে দেখার জন্য তাদের এলাকায় আসা-যাওয়া করতেন।
ইভার সঙ্গে সুজনের বিবাহ হওয়ার আগেই স্থানীয় ছেলে ফাইজুল ইভাকে পছন্দ করতেন। ফাইজুলের সঙ্গে ইভার বড় ভাই আরিফ বন্ধুর মতো চলাফেরা করতেন। ফাইজুল বিভিন্ন সময় ইভাদের বাসায় আসা-যাওয়া করতেন।
এ ঘটনা নিয়ে ফাইজুল ও ইভার বড় ভাই আরিফের সঙ্গে সুজনের বিভিন্ন সময় তর্কবিতর্ক ও হাতাহাতি হয়। ওই সময় সুজন ইভার ভাই আরিফকে চড়-থাপ্পড় দেন এবং আরিফও সুজনকে থাপ্পড় দেন। হত্যা করার ৭/৮ দিন আগে ফাইজুল সুজনকে মারধর করেন।
পরে ২০১১ সালের ১৩ মার্চ সন্ধ্যার পর আরিফুল হক, ফাইজুলের বন্ধু কুটি ও কালা বাবু ইভাদের বাসার সামনে মাঠে বসে সুজনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ মার্চ ২০১১ সন্ধ্যা ৭ টার সময় আরিফ তাদের বাসার পাশের চায়ের দোকান হতে একটি সাদা পলিথিন ব্যাগ নেন। ফাইজুল ও আরিফ লাঠি নিয়ে নিকটস্থ খালপাড় বালুর মাঠের দিকে যেতে থাকেন। এরই মধ্যে কুটি চলে আসেন।
তারা তিনজন এক সঙ্গে খালপার বালুর মাঠে অপেক্ষার কিছুক্ষণের মধ্যে কালা বাবুও চলে আসেন। রাত আনুমানিক ৮টার দিকে কুটির সঙ্গে যোগাযোগ করে ভিকটিম সুজন খালপাড় বালুর মাঠে আসেন।
বিভিন্ন কথাবার্তার একপর্যায়ে ফাইজুল সুজনকে পেছন থেকে হাত দুটি আটকে ধরেন। আরিফ পকেট থেকে পলিথিন বের করে কুটিকে দেন। কুটি পলিথিন ব্যাগ নিয়ে সুজনের মাথার ওপর থেকে গলায় ঢুকিয়ে দিয়েই গলার মধ্যে প্যাঁচ দিয়ে গিট দিয়ে ফেলেন। আরিফ লাঠি হাতে নিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকেন।
পরে কালা বাবু আরিফের হাত থেকে লাঠি নিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকেন। কিছুক্ষণ পরই সুজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুজন মারা গেছেন নিশ্চিত হয়ে তারা ধরাধরি করে লাশ পাশেই খালে ফেলে দেন। কুটি এবং কালা বাবু খালের নিচে নেমে সুজনের লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেন। পরে তারা সবাই এলাকায় চলে আসেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন