বাংলাদেশে সংক্রমণের মূলে ৩ ধরনের করোনা ভাইরাস!
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশ প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও সংক্রমণ থামেনি। বাংলাদেশে মূলত করোনা ভাইরাসের ৩টি ধরন সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশের করোনা ভাইরাসের জিনের কাঠামো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এটা জানতে পেরেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- ডব্লিউএইচও করোনা ভাইরাস বিষয়ে এই তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করছে। তাতে দেখা গেছে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের তিনটি ধরন সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।
তবে বাংলাদেশে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে মূলত জি ধরনের (জি ক্লেড) করোনা ভাইরাস। অন্য দুটি ধরন হচ্ছে জিএইচ ও জিআর। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলোর সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা অনেক বেশি কি না, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে আক্রান্ত হলে মৃত্যু হবেই—এমন নজির দেখা যাচ্ছে না।
চীনের উহানে গত বছরের শেষের দিকে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে। এরপর থেকেই সময়ের ব্যবধানে করোনা ভাইরাসের জিনকাঠামোতে নিয়মিত পরিবর্তন বা মিউটেশন হচ্ছে। পরিবর্তনের ধরনকে চিহ্নিত করার জন্য করোনা ভাইরাসকে এল, এস, ডি, ভি, জি—এ রকম নানা ভাগে ভাগ করেছেন অণুজীববিজ্ঞানীরা।
ভাইরাসের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য জানা-বোঝার জন্য এই তথ্য জরুরি। সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে এই তথ্য কাজে লাগবে বলে জানিয়েছেন ভাইরাসটি নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে এ পর্যন্ত পূর্ণ জিনকাঠামো বিশ্লেষণ (ফুল জিনোম সিকোয়েন্সিং) হয়েছে ২৮৮টি। দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম পূর্ণ জিনকাঠামো বিশ্লেষণ হয়েছিল বেসরকারি চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ল্যাবরেটরিতে।
এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়া অধ্যাপক সমীর সাহা গণমাধ্যমে বলেন, দেশে জি ধরনের বা জি ক্লেডের ভাইরাসের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। মাত্র সাতটি ক্ষেত্রে ডি ধরন পাওয়া গেছে। এই সাতটি পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম এলাকার ল্যাবরেটরিতে।
সমীর সাহা বলেন, জি ধরনেরই উপধরন বা প্রশাখা হচ্ছে জিএইচ ও জিআর। একই কথা বলেন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীরও।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাসের জিনকাঠামো বিশ্লেষণের তথ্য নিয়মিতভাবে জমা দিচ্ছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভেইলেন্স অ্যান্ড রেসপন্স সিস্টেমে (জিআইএসআরএস)। ৪ আগস্ট পর্যন্ত এই দফতরে ৬৯ হাজার ৬৫৫টি পূর্ণ জিনকাঠামো বিশ্লেষণের তথ্য জমা পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোন দেশে করোনা ভাইরাসের কোন ধরনটি বেশি সক্রিয়, তারও তালিকা প্রকাশ করছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে জি, জিএইচ ও জিআর ধরনের করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।
এনিয়ে চলছে গবেষণাও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে কোন ধরনের করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন ইতালির বোলোগ্না বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক।
তারা বলছেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের আদি ভাইরাসটি ছিল এল ধরনের। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে জি ধরনের করোনা ভাইরাস। এরপর এই ভাইরাসের পরিবর্তন বা মিউটেশন হয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর নানা ধরন বা ক্লেড বা স্ট্রেইন দেখা গেছে। জি, জিএইচ ও জিআর হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে উত্তর আমেরিকা ও এশিয়াতে। জি, জিএইচ ও জিআর ধরনের ভাইরাসই এখন মূলত বিশ্বের নানা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।
ঠিক পাঁচ মাস আগে অর্থাৎ ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি ইতালিপ্রবাসী ছিলেন। দেশের বিজ্ঞানীরা বলছেন, জি ধরনের ভাইরাসটি সম্ভবত ইউরোপ থেকেই এসেছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ডি ধরনের ভাইরাসের উৎস ছিল সম্ভবত চীন।
বিজ্ঞান সাময়িকী ফ্রন্টিয়ার্স ইন মাইক্রোবায়োলজিতে ডেনিয়েল মার্সেটালি ও ফেডেরিকো জর্জিনামের গবেষকদের ওই বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। ৪৮ হাজার ৬৩৫টি জিনকাঠামোর তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা বলেছেন, বাংলাদেশ, ভারত, কঙ্গো ও কাজাখস্তানে ভাইরাসের পরিবর্তন বা মিউটেশন বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি। সারা বিশ্বে প্রতিটি নমুনায় গড়ে সাতটি মিউটেশন দেখা গেছে। বাংলাদেশে প্রতিটি ক্ষেত্রে মিউটেশন হয়েছে ৯ দশমিক ৮৩। গবেষকেরা বলছেন, এই পার্থক্য সামান্য হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ।
অণুজীববিজ্ঞানী সমীর সাহা বলেন, ‘ভাইরাস নিয়ে যে তথ্য আমরা পেয়েছি, তাতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। নিশ্চিন্তে থাকারও কোনো অবকাশ নেই। যেকোনো সময় ভাইরাসের বিপজ্জনক পরিবর্তন ঘটবে না, এটা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারে না।’
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসটি সরকারিভাবে কাজ করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর। কিন্তু এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কেউই দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দিতে পারছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা ভাইরাসের ধরন নিয়ে যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ভাইরাসের পরিবর্তনগুলোর ওপর নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে। বড় ধরনের পরিবর্তন হলে সেই অনুযায়ী সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের কাজে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হতে পারে।
ব্রেকিংনিউজ/
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন