বুধবার (১৫ জুলাই) ভোর ৫টা ১০ মিনিট। ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন করোনার ভুয়া রিপোর্ট কাণ্ডের মূলহোতা রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. শাহেদ ওরফে শাহেদ করিম। প্রায় নয়দিন পর সাতক্ষীরা থেকে তাকে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেফতার করে র্যাব। পরে শাহেদকে ঢাকায় আনতে র্যাবের হেলিকপ্টার উড়ে যায় সেখানে। সকাল নয়টার দিকে শাহেদকে বহনকারী হেলিকপ্টার রজধানীর পুরাতন তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
এর আগে র্যাবের গণমাধ্যম শাখা থেকে শাহেদের নিউজ কাভারেজের জন্য ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। এরপরই সংবাদকর্মীরা সেখানে ছুটে যান। হেলিকপ্টার থেকে শাহেদকে নামানোর স্থিরচিত্র ও ভিডিও ধারণ করতে থাকে উপস্থিত সাংবাকর্মীরা। এসময় শাহেদ র্যাব কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি একটি পত্রিকার সম্পাদক, আমাকে বেইজ্জতি করবেন না। আমি টিভি টকশো করি। সাংবাদিকদের অনেক ছবি-ভিডিও দিছেন। এবার এখান থেকে আমাকে দ্রুত নিয়ে চলেন।’
বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) র্যাবের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে তারা ব্রেকিংনিউজকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
শাহেদ র্যাব কর্মকর্তাদের বলেন, দেখছেন আমি একটি পত্রিকার সম্পাদক, আর আমার ছবি তোলার জন্য আমার পত্রিকার সাংবাদিক এসেছে। সে আমার গ্রেফতারের ছবি তুলছে। আমাকে বেইজ্জতি করবেন না। আমি টিভি টকশো করি। সাংবাদিকদের অনেক ছবি-ভিডিও দিছেন। এবার এখান থেকে আমাকে দ্রুত নিয়ে চলুন, প্লিজ।
রিজেন্ট চেয়ারম্যান প্রতারক শাহেদের মালিকানাধীন একটি জাতীয় দৈনিক আছে। তিনি সেই পত্রিকার সম্পাদক।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের অভিযান চালায় র্যাব। এরপর থেকে আত্মগোপনে চলে যান রিজেন্ট চেয়ারম্যান। নিজের গ্রেফতার এড়াতে তিনি বিভিন্ন সময় নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে যান। বিশেষ করে নিজের শ্বশুর বাড়িতে গেলেও সেখানে আশ্রয় পাননি। এরপর চলে যান কুমিল্লা, কক্সবাজার, মানিকগঞ্জ ছাড়াও সর্বশেষ নিজের জন্মভূমি সাতক্ষীরায়। কিন্তু কেউ তাকে আশ্রয় দেয়নি। বরং সবাই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এরপরই সিদ্ধান্ত নেন পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে পাড়ি দেবেন। সে অনুযায়ী সবকিছু ঠিকও করেন।
গত মঙ্গলবার শাহেদের নৌকাযোগে ভারত যাবার কথা ছিল। কিন্তু নৌকার মাঝি বাচ্চু অন্য একটি দূর (মানুষ বা মালামাল নিয়ে সীমান্তে পারাপার) নিয়ে ভারতে যাওয়ায় শাহেদের যাত্রা বন্ধ হয়। মাঝি ফিরে এসে জানান, ভোরে তাকে পার করে দিবেন। সেজন্য গতরাত থেকেই সাতক্ষীরা সীমান্তের দেভাটার কমলপুর গ্রামের ইছামতি খালে অপেক্ষা করতে থাকে শাহেদ। ভোরে পারাপারের কথা থাকলেও পরে তিনি র্যাবের হাতে ধরা পড়ে যান।
বুধবার (১৫ জুলাই) র্যাব সদরদপ্তরে ব্রিফিংয়ে এলিট ফোর্সটির মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শাহেদের প্রতিষ্ঠানে অভিযানের পর থেকে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। সে একেক দিন একেক জায়গা থেকেছেন। ঢাকা থেকে কক্সবাজার, কুমিল্লা গেছেন বাসে। আবার ট্রাকে ও পাঁয়ে হেটে সাতক্ষীরা গেছেন। সেখান থেকে তিনি নদী পার হয়ে ভারত যাবার চেষ্টা করছিল। এরপরই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
যেখানে পালিয়ে ছিলেন শাহেদ
শাহেদ গ্রেফতার এড়াতে নিকট আত্মীয়দের বাড়িতে গেলেও তাকে কেউ রাখেনি। কারণ বিভিন্ন মিডিয়ায় শাহেদকে খোঁজা হচ্ছে এমন সংবাদ দেখে অনেকে সতর্ক হয়ে যান। নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই তারা এমনটি করেছেন। কয়েকজন আত্মীয় তাকে একবারেই বের করে দেন। তবে কয়েকজন রাত্রি যাপনের সুযোগ দিলেও ভোরে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। রিজেন্টের এমডি পারভেজের ভায়রার বাড়িতে যাবার পর তিনি গাড়ি দিয়ে পারভেজকে কক্সবাজার পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছিলে। এরবাইরে তিনি বিভিন্ন পন্থায় একাই চলাফেরা করেছেন।
সীমান্ত পার করে দিলেই ৫০ লাখে রফাদফা
র্যাব সূত্র জানায়, ৫৬ মাললার আসামি প্রতারক শাহেদ করিম ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ভারতে পার করে দিতে আল ফেরদৌস আলফার সঙ্গে ৫০ লাখ টাকায় চুক্তি করেন প্রতারক শাহেদ। সে হিসেবে শাহেদকে আলফা সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলা শাকরা কোমরপুরে তার মাছের ঘেরে আশ্রয় দেয় আলফা। সেখানে এসি ঘরে চার দিনের মতো ছিলেন রিজেন্ট চেয়ারম্যান। এই সময়ের মধ্যে শাহেদকে ভারতে পালিয়ে যেতে নৌকা ও মাঝির ব্যবস্থা করেন আলফা। আল ফেরদৌস আলফা সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র মতে, ওই অঞ্চলে তিনি একজন কুখ্যাত চোরাকারবারি বলে পরিচিত। কিছুদিন আগেও তিনি চোরাচালান মামলায় জেলে ছিলেন। আলফা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তালিকাভুক্ত হুন্ডি ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী। তারপরেও বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য পদে রয়েছেন।
সূত্র জানায়, আলফার ভাই আব্দুল আলিম সাতক্ষীরা চাঞ্চল্যকর বিজিবি সদস্য আব্দুল জব্বার হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে মামলাটি করেন ভোমরা বিজিবির নায়েক মো. নাসির উদ্দীন। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
১০ হাজার পরীক্ষায় ৬ হাজার ভুয়া রিপোর্ট
তার বিরুদ্ধে অনেক মামলার বিষয়ে জানা গেছে। সেসবের তথ্য যাচাই বাছাইয়ের কাজ চলছে। করোনা পরীক্ষার রিপোর্টের নামে প্রতারণা করছিল উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিনামূল্যে পরীক্ষা করার কথা থাকলেও সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা করে নেওয়া হতো এবং পুনরায় পরীক্ষার জন্য আরও এক হাজার টাকা গ্রহণ করতো। আইসিইউতে ভর্তি করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতো। এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের অধিক পরীক্ষা করে ৬ হাজার ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে সাহেদের প্রতিষ্ঠান। একদিকে রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, আরেক দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিলেরও জন্য জমা দিয়েছে সাহেদের হাসপাতাল রিজেন্ট।
জাল টাকা দিয়ে প্রতারণা
শাহেদকে ঢাকায় আনার পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে নিয়ে উত্তরার গোপন একটি অফিসে অভিযান চালায় র্যাব। ওই অফিস থেকে এক লাখ ৪৬ হাজার জাল টাকা উদ্ধার করা হয়। র্যাব মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, এসব জাল টাকা দিয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন শাহেদ। তিনি মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মানুষের কাছ থেকে বেশি দামে বাকিতে মাল কিনে তা কম দামে বিক্রি করে দিয়ে ক্যাশ টাকা সংগ্রহ করতেন। কিন্তু ওইসব পাওনাদারদের টাকা কোনোদিন পরিশোধ করতেন না। টাকা চাইতে গেলে ভয়ভীতি দেখাতেন। অস্ত্রধারীদের দিয়ে ভয় দেখাতেন। কাউকে কাউকে জাল টাকা ঋণ দিয়েও পরিশোধের কথা বলতেন প্রতারক শাহেদ।
শাহেদের দাম্ভিকতা
গ্রেফতার পর শাহেদে প্রথম র্যাব কর্মকর্তাদের কাছে নিজেকে একটি পত্রিকার সম্পাদক পরিচয় দেন। তাতে কাজ না হলে নিজেকে একটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান পরিচয় দেন। উপস্থিত অভিযানিক দলের কর্মকর্তাদের বলেন, আমি হত্যা বা ধর্ষণ করিনি। আমাকে বেশি দিন আটকে রাখা যাবে না। ছয়মাস পর ছাড়া পেয়ে ঠিকই আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন