রোকেয়া কবীর বেসরকারি সংস্থা নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক। সকল বাধা জয় করে বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে নেয়ার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
ছাত্র রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, নারী আন্দোলনের মাধ্যমে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, জেন্ডার সংবেদনশীল পাঠ্যপুস্তক ও সংবাদ পরিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
তার হাত ধরে বাংলাদেশের নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
যুগান্তর: করোনায় ঘরবন্দি সময়ে কীভাবে কাজ করছেন?
রোকেয়া কবীর: করোনায় ঘরবন্দি হলেও আমাদের কাজ থেমে নেই। আমাদের সংগঠনগুলোর মাধ্যমে কর্ম এলাকা নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, ঢাকার পূর্ব-পশ্চিম এলাকার নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন ও সমঅধিকার, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীবান্ধব বাথরুম ইত্যাদি বিষয়ক সচেতনতামূলক কাজগুলো টেলিফোনের মাধ্যমে চলমান রেখেছি।
কর্ম এলাকার প্রতিটি গ্রুপের লিডার তাদের সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করছেন। তাদের খাদ্য সরবরাহ ও সাবান ইত্যাদি বিতরণ করা হয়েছে। মাইকিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকারের ত্রাণ বিতরণের তালিকা তৈরিতে সহায়তা করেছি।
যুগান্তর: বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে আপনার সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। এর সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?
রোকেয়া কবীর: ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হই। কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হই। গভ: ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের এইচএসসির ছাত্রী আমি। এই বছরই কলেজের ছাত্রী সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি এই ছাত্রী সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্মানে ভর্তি হই। ওই বছরই সহপাঠীদের সঙ্গে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিই। ’৭০ এর নির্বাচনে শ্রমিক, কৃষক আন্দোলনে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করি। অসহযোগ আন্দোলনে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিই।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রহ করি। তাদের রাজনৈতিক ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। এরপর প্রশিক্ষণ শেষে তাদের দেশের ভেতরে পাঠাই।
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিই। পাশাপাশি দেশগড়ার সংগ্রামে যুক্ত হই। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হই। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট এম এ পরীক্ষা শেষ হলো। এরপরের দিনই সংবাদ পেলাম ভোর রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। আমরা কিছুদিনের জন্য আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেলাম।
ফিরে এসে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের নারীর অধিকার, উন্নয়ন, সচেতনতা বিষয়ে সংগঠিত করার কাজ শুরু করি। ১৯৭৬ সালে বিআইডিএসে (বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান) একটি প্রজেক্টে যোগদান করলাম।
এই প্রজেক্টের আওতায় ৩ বছর ময়মনসিংহের ৬টি গ্রামে ‘নারীর কাজ’ নিয়ে একটি গবেষণা কর্ম পরিচালনা করি। এসময়ই নারীর কর্মভার, গ্রামীণ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নারীরা কীভাবে অংশগ্রহণ করছেন, পরিবারের আয় বৃদ্ধি করার জন্য তারা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হচ্ছেন সে সম্পর্কে ধারণা জন্মে।
নারীর কাজ সম্পর্কে সাধারণ ধারণার বাইরে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি। প্রচলিত ধারণা নারীরা ঘরে বসে থাকেন, আয়-উপার্জন বা অর্থনৈতিক কোনো কাজ করেন না, এই যে ব্যাপক ধারণা। এই ধারণার বিপরীতে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে উপলব্ধি জন্মায়।
১৯৭৮ সালে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করি। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এখানে কর্মরত ছিলাম। কর্মক্ষেত্রের এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই নারীর অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটি মাত্র ৪৫ দিন। সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা নারীরা কীভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন; তা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ ঘটে।
এ ব্যাপারে অভিযোগ নিয়ে গেলে ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা বলতেন নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করতে এলে এই অবস্থা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে।
এই অবস্থার পরিবর্তন করার জন্য নারী প্রগতি সংঘ গঠন করে ১৯৮৬ সালে কাজ শুরু করি।
যুগান্তর: এমন কয়েকজন নারী নেত্রীর কথা বলবেন কি যারা সমাজে নারী-পুরুষের সামাজিক-মানসিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে?
রোকেয়া কবীর: বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যাত্রা শুরু হয় কবি সুফিয়া কামালের হাত ধরে। এছাড়া বরিশালের মনোরমা মাসীমা, বদরুন্নেসা আহমেদ এমপি, হেনা দাস, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম, সাধারণ সম্পাদিকা মালেকা বানু প্রমুখ নারী নেত্রী নারী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের নিরলস কর্মকান্ডের ফলশ্রুতিতে সমাজে নারী-পুরুষের সামাজিক-মানসিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
যুগান্তর: লেখালেখির সঙ্গেও আপনি দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত। আপনার প্রকাশিত বইগুলো সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
রোকেয়া কবীর: সেভাবে সময় না পাওয়ার কারণে নিয়মিত লেখালেখি হয়ে ওঠে না। মাঝেমধ্যে আর্টিকেল লিখি। ‘মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে’ – একথা সবসময় বলা হতো।
’৯০ দশকে এর যুক্তি খন্ডানোর জন্য বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখি করি। সারা দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধে যে নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন প্রাথমিকভাবে তাদের মধ্যে ৪০০ নারীর তালিকা সংগ্রহ করি ।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মার্চ মাসে শাহবাগের সামনে একটি গণসংবর্ধনার আয়োজন করি। এই নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণী নিয়ে ‘সংগ্রামী নারী যুগে যুগে’ বইটি প্রকাশ করি।
ব্রিটিশ সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় পর্যন্ত যেসব নারী মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের কথা বইতে তুলে ধরা হয়েছে। এই বইটি লেখার উদ্দেশ্য হলো পরবর্তীতে গবেষকরা যারা নারীর ভূমিকা ও নারী আন্দোলন নিয়ে কাজ করবেন তারা এই সূত্র ধরে এগতে পারবেন। আর দুটি বইয়ের মধ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও নারী’, ‘বাংলাদেশের নারীর অগ্রযাত্রা ও প্রতিবন্ধকতা’।
১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিই। ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে সম্মিলিত নারী সমাজ গড়ে ওঠে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রস্তুতকরণে আইভী রহমানের নেতৃত্বে কোঅর্ডিনেশনের দায়িত্ব পালন করি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। সম্মিলিত নারী সমাজের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আইভী রহমান জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির খসড়া প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।
যুগান্তর: বাংলাদেশ ও বিশ্বের নারী আন্দোলনের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কি?
রোকেয়া কবীর: বাংলাদেশ ও বিশ্বের নারী আন্দোলনের মধ্যে সে রকম কোনো পার্থক্য নেই। লেবেলের পার্থক্য রয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে যে পার্থক্য রয়েছে; সেই পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়।
বিশেষ করে ইস্যুগুলো– যেমন আমাদের দেশে ঘরের কাজে পুরুষরা অংশগ্রহণ করবে কি করবে না? উন্নত বিশ্বে পুরুষরা সমভাবে কাজ করছে। উত্তরাধিকার নিয়ে এখনও আন্দোলন করতে হচ্ছে। নারীর শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিয়ে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। সমাজে স্বাধীনভাবে বসবাস, চলাফেরার পার্থক্য তো রয়েছেই।
যুগান্তর: আপনার দেখা সেরা চলচ্চিত্র কোনটি ?
রোকেয়া কবীর: ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘ দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’, ‘সান ফ্লাওয়ার’ এই চলচ্চিত্রগুলো মনে দাগ কেটেছে।
যুগান্তর: আপনার ভালো লাগা প্রথম চলচ্চিত্র কোনটি?
রোকেয়া কবীর: এই চলচ্চিত্রগুলোই প্রথম দেখি ছাত্রজীবনে।
যুগান্তর: আপনার প্রিয় বই, লেখকের কথা জানতে চাই। যা আপনাকে আলোড়িত করেছে?
রোকেয়া কবীর: বাঙালি লেখকদের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের বই আমাকে বারবার টানে। বিশ্ব সাহিত্যের মধ্যে ফিওদোর দস্তয়েভস্কির - ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’, ‘ইডিয়ট’ ইত্যাদি বই রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছে আমাকে। নারী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পর পড়েছি রোকেয়া রচনাবলী।
যুগান্তর: কখন কি মনে হয়েছে একে ভালোবাসি। একে ছাড়া জীবন চলবে না?
রোকেয়া কবীর: ছাত্র জীবনে ভালোবাসা, পছন্দ সবই ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় অঙ্গীকার ছিল জীবনটা জনগণের জন্য। তার মানে এই নয়, ভালোবাসার মানুষকে না পেলে মরে যাব। এমন ছিল না। তবে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গেই ঘর বেঁধেছি।
যুগান্তর: আমাদের সমাজব্যবস্থা নিয়ে কিছু বলেন?
রোকেয়া কবীর: আমাদের সমাজব্যবস্থা এখনও পুরুষতান্ত্রিক, শ্রেণিভিত্তিক। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, পরিবহন, শিল্প (জাতীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে নেয়া হয়েছিল)।
সেগুলো ’৭৫ এর পট পরিবর্তনের পরে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল), এসএপি (স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসি) গ্রহণ করে সব বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। এর ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াত ব্যবস্থা সব বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়।
অর্থনীতি পুরোটাই বাজারের হাতে চলে যায়। এর ফলশ্রুতিতে আমরা এখন দেখছি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কি বেহাল অবস্থা। সুতরাং বর্তমানে খোলা বাজার অর্থনীতির যে ব্যবস্থা রয়েছে; তার যাত্রা শুরু ’৭৫ এর পরবর্তীতে।
পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার সংবেদনশীল করার জন্য কাজ করেছি। মাদরাসা শিক্ষায় নারী বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধিতার প্রাধান্য ছিল। ’৯১-’৯২ সালে কাজের মাধ্যমে এই বিষয়টা জাতির সামনে তুলে ধরা হয়।
’৮০ দশকে নারী নির্যাতনের রিপোর্টগুলোতে ভিকটিম নারীর ছবি, পরিচয় ফলাও করে প্রকাশ করা হতো। আসামির ছবি ও পরিচয় দেয়া হতো না। জেন্ডার সংবেদনশীল রিপোর্ট তৈরির জন্য ক্রাইম রিপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনকে যুক্ত করে সাংবাদিকদের জেন্ডার সংবেদনশীল প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন