গত ১১ মে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় এক হাজার ৩৪ জন, এরপর ১২ মে ৯৬৯ জন এবং ১৬ মেতে ৯৩০ জন শনাক্ত হন। ১৭ মে থেকে শনাক্ত হওয়া রোগী সংখ্যা এক হাজারের নিচে আর নামেনি। প্রায় প্রতিদিনই শনাক্ত হওয়া রোগী সংখ্যা ভেঙেছে তার আগের দিনের রেকর্ড। আর এভাবেই শুক্রবার ( ২৯ মে) এ যাবতকালে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ৫২৩ জন।
গত ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। ২৬ মার্চ থেকে সরকারি-বেসরকারি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান, যানবাহন বন্ধ ঘোষণা করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে তা কয়েক দফা বাড়ানো হয়। তবে সাধারণ ছুটি থাকছে না আগামীকাল রবিবার (৩১ মে) থেকে। কেবলমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছুই চলবে, চলবে গণপরিবহনও। সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সীমিত পরিসরে শব্দ দুটি যোগ করলেও সেটা কতোটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
তারা বলছেন, রোগী বাড়ার কার্ভ বাড়ছে। কার্ভ বাড়ার মানে হচ্ছে আমরা এখন কেবল চূড়ার দিকে যাচ্ছি। সে গতি আগের চাইতে আরও দ্রুত হয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ ছুটি তুলে দিলে ‘এপিডেমিক এক্সপ্লোশন’-এর আশঙ্কা রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ ছুটির ভেতরেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের একবার ঢাকায় আনা, আবার তাদের ফেরত যাওয়া, হোটেল রেস্টুরেন্ট সীমিত আকারে খুলে দেওয়া, ঈদের আগে শপিং মল খুলে দেওয়ার কারণে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে মে মাসের শেষে মানুষ সংক্রমিত হয়েছে বেশি। আর এখন যদি সাধারণ ছুটি তুলে দেওয়া হয় তাহলে বাংলাদেশ সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে এক কঠিন সময়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
এদিকে, কোভিড বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি বলেছে,সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযোজ্য বিধি-বিধান সঠিকভাবে প্রয়োগ না করে শিথিল করা হলে রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। গত ২৮ মে কমিটির ষষ্ঠ সভার সুপারিশে এ কথা বলা হয়েছে।
দেশে প্রথম তিনজন করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ আর প্রথম করোনাতে আক্রান্ত রোগী মারা যান তার ঠিক ১০ দিন পর ১৮ মার্চ। সে হিসেবে সংক্রমণের ৮৪তম দিনে এসে দেশে এখন পর্যন্ত করোনাতে আক্রান্ত হওয়া রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৪৪ হাজার ৬০৮ জন আর মারা গেছেন ৬১০ জন। সুস্থ হয়েছেন নয় হাজার ৩৭৫ জন। মার্চ মাসে মোট মারা যান ৫ জন, এপ্রিলে মারা যান ১৬৩ জন আর চলতি মাসে মারা যান ৪৪২ জন।
করোনা বিস্তারে হার যখন এমন বাড়ছে ঠিক তখনই সবকিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছুটি হবে না—বলা মানে সবাইকে ইশারা দেওয়া যে সবাই নেমে পরতে পারো। ঈদের সময়ে শপিং মল খুলে দিয়ে যে ভুল হয়েছিল। আমরা এখন মাত্র চূড়ার দিকে যাচ্ছি মন্তব্য করে তিনি বলেন, এতদিন সংক্রমণ ছিল বিভিন্ন ক্লাস্টারে ছড়িয়ে থাকা কিন্তু এখন এক জায়গাতেই বড় ক্লাস্টার হবে যেখানে অনেক লোক আক্রান্ত হবে এবং সেটা হলেই ক্ষতি অনেক বেশি হবে। এপিডেমিক এক্সপ্লোশন-এর আশঙ্কা রয়েছে। তাই সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়ার মতো ঢালাও সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত, এখনও সময় আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দিনকে দিন সংক্রমণ বাড়বে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বাদ দিয়ে হোম কোয়ারেন্টিন করাটাই ছিল প্রথম ভুল, তাতে করে এতো সংক্রমণ হয়েছে। ছুটি তুলে দিলে সেটা কোন পর্যায়ে যাবে সেটা বলাই বাহুল্য, সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে একটা কঠিন সময়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কেবল ১৫টি দিন অপেক্ষা..তারপর সেটা দেখা যাবে। একটা কঠিন সময়ের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ, কেবল এইটুকুই বলতে পারি।
নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ কঠিন সময়ের দিকে যাচ্ছে মন্তব্য করে জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক চিন্ময় দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভুল যা হওয়ার হয়েছে তবে এখনও সময় আছে। পৃথিবীতে যারা প্রথম থেকেই লকডাউন বা এরকম পরিস্থিতিতে ছিল তারা খুব ভালো অবস্থানে গেছে, যারা ছেড়ে দিয়েছে তাদের অবস্থা খারাপের দিকে গেছে।
তারপরও মানুষের জীবন-জীবিকার কথা মাথায় রাখতে হবে মন্তব্য করে চিন্ময় দাস বলেন, প্রতিটি মহামারীর ‘পিক’ রয়েছে, পিকের পর ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে দিতে হবে। কিন্তু এভাবে যদি হঠাৎ করে ছুটি তুলে দেওয়া হয়, হয়তো একটা আচমকা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন