ইশরাত হাসান
বরগুনার আমতলী থানার অফিসার ইন-চার্জের অফিস কক্ষে যার ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেছে, তার নাম শানু হাওলাদার। তিনি উক্ত থানার গুলিশাখালী ইউনিয়নের পশ্চিম কলাগাছিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তার কাছে চাঁদা চেয়েছিল অফিসার ইন-চার্জ। চাঁদা না পেয়ে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আর পুলিশের দাবি, শানু হাওলাদার আত্মহত্যা করেছেন। রিপোর্ট অনুযায়ী শানু হাওলাদারকে গ্রেফতার করা হয় ২৩ মার্চ, ২০২০। আর থানার অফিসার ইন-চার্জের অফিস কক্ষে তার ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায় ২৮ মার্চ, ২০২০। এরকম ঘটেনি যে শানু হাওলাদারকে আদালতে চালান দিয়ে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে এবং আদালত তাকে রিমান্ডের আদেশ দিয়ে আবার পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছেন। আবার যতদূর জানি, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে এমন কোনও থানা নেই, যেখান থেকে জেলা শহরে যেতে চারদিন লাগে। তাহলে ২৩ মার্চ গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত এই চারদিন শানু হাওলাদার কোথায় ছিলেন?
হিসাব সহজ, গ্রেফতারের পর থেকে তিনি থানা হাজতেই ছিলেন। পুলিশের দাবি অনুযায়ী শানু হাওলাদার যদি গুরুতর কোনও অপরাধও করেন তবে তাকে কেন যথাসময়ে আদালতে সোপর্দ করা হলো না? বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩ অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে থানা থেকে আদালতে পাঠানোর সময় বাদ দিয়ে অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে উপস্থাপন করতে হবে। সাংবিধানিক এই বিধান ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লিখিত বিধান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শানু হাওলাদারকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থিত না করায় তার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার যেমন ভঙ্গ হয়েছে, তেমনি ফৌজদারি কার্যবিধি লঙ্ঘন হয়েছে যা গুরুতর অপরাধ।
একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে কেন থানার ওসির কক্ষ বেছে নেবেন? পুলিশ ২৩ মার্চ তাকে বাড়ি থেকে ধরে থানায় নিয়ে গেলো। আর চার দিনের মাথায় তিনি লাশ হয়ে গেলেন! ওসির কক্ষে একজন মানুষ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করলেন, আর কেউ দেখলো না! আর তিনি আত্মহত্যা করার জন্য দড়িই বা কোথায় পেলেন। ওসি সাহেব কোথায় ছিলেন? অন্যান্য পুলিশ সদস্যও বা কোথায় ছিলেন? ওসি সাহেব কি একজন আসামির জন্য তার কক্ষ ছেড়ে দিয়েছিলেন, যাতে ওই আসামি নিরাপদে আত্মহত্যা করতে পারেন। এরকম নানা প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে এখন। দণ্ডবিধি অনুযায়ী আত্মহত্যার চেষ্টা যেমন অপরাধ, তেমনি আত্মহত্যায় প্ররোচনা বা সহায়তাও তেমনই অপরাধ।
একথা স্বীকৃত যে শানু হাওলাদার ওসির অফিস কক্ষে মারা গেছেন এবং তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে ছিলেন। অর্থাৎ তার জীবনের সুরক্ষার দায়িত্ব ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর। কোনও সরকারি কর্মকর্তা অথবা তার পক্ষে কর্তব্যরত কোনও ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে অভিযোগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে যে তার বা তার পক্ষে কর্তব্যরত ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে ওই ক্ষতি হয়নি। এক্ষেত্রে থানার অফিসার ইন-চার্জ বা তার অধীনস্থ কর্মকর্তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে শানু হাওলাদারকে তিনি বা তারা হত্যা করেননি অথবা শানু হাওলাদার অফিসার ইন-চার্জ বা তার অধীনস্থ কর্মকর্তার প্ররোচনায় আত্মহত্যা করেননি।
বাংলাদেশ ২০১৩ সালে নির্যাতন, হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী সরকারি কোনও কর্মকর্তার হেফাজতে কোনও ব্যক্তির মৃত্যু, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গ্রেফতারকালে কোনও ব্যক্তির মৃত্যু বা জিজ্ঞাসাবাদকালে কোনও ব্যক্তির মৃত্যুও এতে অন্তর্ভুক্ত। আমি মনে করি, বরগুনার শানু হাওলাদারের মৃত্যু হেফাজতে মৃত্যুর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। যেহেতু তার পরিবারের দাবি, পুলিশ দাবিকৃত চাঁদার টাকা না পেয়ে শানু হাওলাদারকে হত্যা করেছে, সেহেতু শানুর পরিবারের কোনও সদস্য বা নিকটস্থ আত্মীয় এমনকি তৃতীয় কোনও পক্ষ সংশ্লিষ্ট দায়রা জজ (দায়রা জজ, বরগুনা) আদালতে লিখিত অভিযোগ দাখিল করতে পারেন। উক্ত অভিযোগ প্রাপ্ত হয়ে বিজ্ঞ দায়রা জজ মামলা দায়ের করার প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে আবেদনের ভিত্তিতে অভিযোগকারীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার আদেশ প্রদানের এখতিয়ারও আদালতের রয়েছে। এই ধরনের অপরাধকে গুরুতর বিবেচনা করেই আইন প্রণেতারা এই অপরাধের বিচারের সময়সীমা ১৮০ দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা অবশ্য পালনীয়। অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি হত্যাকাণ্ডের শাস্তির সমতুল্য অর্থাৎ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। হেফাজতে মৃত্যু প্রমাণ করতে গিয়ে অথবা হত্যা মামলায় অথবা কোনও তদন্ত প্রতিবেদনে যদি আসামি কর্তৃক হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা প্রযোজ্য হতে পারে, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়াও ভিকটিমের (মৃত শানু হাওলাদার) পরিবার এই মৃত্যুর জন্য আদালতের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিকট ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবে।
যদিও শানু হাওলাদারের পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা কোনও আইন শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ দিয়ে পূরণ করতে পারবে না। তথাপি এই মৃত্যুর জন্য যদি দায়ী ব্যক্তির বিচার হয় তবে হয়তো ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অপরাধীদের জন্য এটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। তাতে হয়তো আগামী দিনের শানু হাওলাদাররা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা পাবেন।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
পাঠক মন্তব্য
You should file a case against this terrorist including his leaders Home Minister Kamal ,and Law Minister Anis and Atttorney general Alam. They are responsible for corrupting the police and making them terrorists.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন