অবশেষে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রাশিদুল ইসলামকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকা লুটপাটসহ ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি করায় এই পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় রাশিদুল ইসলামকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে বদলির আদেশ জারি করে। ওই আদেশের পরেও চেয়ারম্যান পদে বহাল থাকতে প্রভাবশালী মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন রাশিদুল ইসলাম। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। জানা গেছে, ইতিপূর্বে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা- এনএসআইয়ের তদন্তে তার ব্যাপক দুর্নীতি লুটপাটের প্রমাণ উঠে আসে। সেই প্রেক্ষিতে তাকে তখন সতর্কও করা হয়। কিন্তু তাতে তিনি সতর্ক না হয়ে আরো বেপরোয়া দুর্নীতি-জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন। আর এ কারণেই গত ৪ ফেব্রুয়ারি তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। এই বদলির পরও উল্টো এখানে থেকে যাওয়ার তদবির করায় সরকারের শীর্ষ মহল অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। জরুরিভিত্তিতে রাশিদুল ইসলামকে রিলিজ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত ৯ ফেব্রুয়ারি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছে তাকে। এদিকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পর একে একে রাশিদুল ইসলামের নানা অপকর্মের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে। এতদিন মুখ বন্ধ করে সহ্য করা ভুক্তভোগী ও কর্মকর্তারা তার অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার সব তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছেন।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই দুর্নীতিবাজদের একত্র করে নতুন সিন্ডিকেট গড়ে তুলে প্রতিষ্ঠানটিকে হরিলুটের আখড়ায় পরিণত করেন রাশিদুল ইসলাম। একইসঙ্গে আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি অর্থ ব্যয় করেন। এর আগে তিনি একই প্রতিষ্ঠানে সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলো ছিল তার নখদর্পণে। এ কারণে শীর্ষ পদে আসীন হবার পর তার মধ্যে ‘ড্যামকেয়ার’ ভাব চলে আসে। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই দুর্নীতির থাবা বিস্তার শুরু করেন। রাশিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ফ্ল্যাট বা প্লট বরাদ্দের নামে চলে কোটি কোটি টাকার রমরমা বাণিজ্য। নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে লুটে নেন বিশাল অংকের অর্থ।
বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ করায় রাশিদুল ইসলামের এসব দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা- এনএসআই। এনএসআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মতো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে অনিয়ম, দুর্নীতি, অবৈধ অর্থ লেনদেনের পরিবেশ এমন প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, যত সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা পদায়ন দেওয়া হোক না কেন, হয় তাকে দুর্নীতিতে সহায়তা করতে হবে, নতুবা অপমান-লাঞ্ছনা, দুর্নাম নিয়ে বিতাড়িত হবে মর্মে প্রতীয়মান।’ সংস্থাটি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ শত শত কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ এনে প্রতিবেদন দেয়। দুদকও তদন্ত শুরু করে। যদিও দুদকের একজন কমিশনারের আশীর্বাদে দুর্নীতি মামলাটি ধামাচাপা পড়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এনএসআইয়ের তদন্তে রাশিদুল ইসলামের দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। গত বছরের ২৬ মে সংস্থাটি সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করে। সরকারের সম্পত্তি ভুয়া নামজারির মাধ্যমে অবৈধভাবে বিক্রি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফ্ল্যাট বরাদ্দে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থলুট, গ্রহীতাদের ব্ল্যাকমেইলিং করে ঘুষ নেয়া, রাজধানীর লালমাটিয়া প্রকল্পে অবৈধভাবে নিজ নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ, মোহাম্মদপুরে বড় অংকের ঘুষের বিনিময়ে কাজ প্রদান, রাজশাহীর তেরখাদিয়া প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, বিভিন্ন পদে বদলি বাণিজ্য করে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ, চেয়ারম্যানের পদ দখলে নিতে প্রভাবশালী মহলকে বড় অংকের ঘুষ প্রদান, সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) থাকাকালীন ঊর্ধ্বতনদের সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন সময়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে মোটা অংকের অর্থসহ ফ্ল্যাট/প্লট উৎকোচ দেয়াসহ অনেক অপকীর্তি এনএসআইয়ের ওই প্রতিবেদনে উঠে আসে।
ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লুটপাটের অর্থ ভাগাভাগিতে মনোমালিন্য হওয়ায় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অনেক কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক বদলি করেছেন রাশিদুল। তার মানসিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিবসহ রাঘব-বোয়ালদের ফ্ল্যাট-প্লটসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে চেয়ারম্যান পদকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ রুখে দাঁড়াতে পারেনি। যে বা যারাই তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তাদেরকে হুমকি-ধামকি, শাস্তিমূলক বদলি, বহিষ্কারসহ নানাভাবে হয়রানির স্বীকার হতে হয়। কারণ সরকারের প্রভাবশালী মহল ও প্রশাসনের বড়কর্তাদের ম্যানেজ করে চলেন তিনি। তাই অনিয়ম, দুর্নীতিতে কাউকে তোয়াক্কা করতেন না।
রাশিদুলের এসব অপকর্মের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে প্রভাবশালী কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের ইঙ্গিত রয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে রাশিদুলের স্বেচ্ছাচারিতার আরো তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামানের অবসর গ্রহণের ৩ মাস আগে দাপ্তরিক প্রয়োজনে বিদেশ সফরকালীন বিপুল অর্থ খরচ করে রাশিদুল ইসলাম জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে তার পদায়ন নিশ্চিত করেন।
এছাড়া ফাইল হতে ক্লায়েন্টদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে বিভিন্ন ত্রুটির অজুহাতে (তার নির্ধারিত) লোক দিয়ে যোগাযোগ করে ঘুষ দাবি এবং গ্রহণ করেন। প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তোলপাড় হলে রাশিদুল সেটি ধামাচাপা দিতে হাইভোল্টেজ তদবির শুরু করেন। একইসঙ্গে নিজের দুর্নীতি আড়াল করতে গৃহায়ণ ভবনে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। পাশাপাশি কৌশল পাল্টে দুর্নীতির মাত্রাও বাড়িয়ে দেন।
অর্ধশত প্লট গায়েব করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ
রাজধানীর দুয়ারীপাড়া প্রকল্পে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ৪৭৪টি প্লট অবৈধ দখলমুক্ত করার পর অন্তত অর্ধশত প্লট গায়েব করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে রাশিদুল সিন্ডিকেট। তবে বৃহৎ এই দুর্নীতি দুদকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে- বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, এই প্রকল্পে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ও যানবাহনের জন্য খরচ বাবদ গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের প্রাক্কলন ছিল ৩৫ লাখ টাকা। অথচ চেয়ারম্যান রাশিদুল ইসলাম ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ খাতে কোটি টাকার ওপর ব্যয় দেখিয়েছেন। ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে তিনি মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পাশাপাশি দুয়ারীপাড়ায় বরাদ্দ গ্রহীতা সমিতির কাছ থেকেও মোটা অংকের কমিশন হাতিয়ে নিয়েছেন। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, ৪৭৪টি প্লট অবৈধ দখলে থাকলেও উদ্ধারের পর অন্তত অর্ধশত প্লট গায়েব হয়ে গেছে। গায়েব হওয়া এসব প্লট গোপনে অন্যত্র বিক্রি কিংবা আর্থিক সুবিধা পেয়ে পূর্বের বরাদ্দ গ্রহীতা কাউকে বাড়তি জমি দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। এদিকে মিরপুর স্যাটেলাইট টাউন প্রকল্পে ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়ে রাশিদুল ইসলামের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে দুদক। চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালে গত ২৬ জানুয়ারি দুদক উপ-পরিচালক নূরুল হুদা এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠান। এনএসআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৫০লাখ টাকা অগ্রিমসহ দুই কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে মিরপুরস্থ ১০-বি/১-৯ নং প্লটটি বিনামূল্যে ব্যক্তি মালিকানায় বরাদ্দ প্রদান করে দিয়েছেন রাশিদুল ইসলাম। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্লট/ফ্ল্যাট বরাদ্দের ক্ষেত্রে নির্ধারিত কোটা রয়েছে। সেক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে আবেদনপত্র দাখিল করতে হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান রাশিদুল ইসলাম নির্ধারিত সময়ে আবেদন না করে, বোর্ড সদস্য হিসেবে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে মোহাম্মদপুর লালমাটিয়া প্রকল্পে ১৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট অবৈধভাবে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য নিজের নামে বরাদ্দ নিয়েছেন। এছাড়া তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর নিম্নপদে বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন