বাংলাদেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থা নিয়ে আদালতে অভিমত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম।
মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে হাজির হয়ে তারা লিখিত আকারে এ মত তুলে ধরেন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিকল্পনা (স্কিম) ছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডকে টিকিয়ে রাখা দুরূহ। তবে বাংলাদেশের ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো.শাহ আলম বলেন, যদি কোম্পানিটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিলোপ, অপসারণ, নতুন নিয়োগ বা পুনর্গঠন করা হয়, তবে কোম্পানিটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
শুনানিতে আদালত বলেন, প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচার বিষয়ে গণমাধ্যমে আসা তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মিলছে না। এটা কি শুভঙ্করের ফাঁকি? পরে এ বিষয়ে আদেশের জন্য বুধবার দিন ঠিক করেন আদালত।
গত ১৯ জানুয়ারি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) থেকে অপসারিত পি কে হালদারের পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদেশে পি কে হালদারের মা, স্ত্রী, ভাইসহ ওই কোম্পানির শীর্ষ ১৯ কর্মকর্তার পাসপোর্ট জব্দের আদেশও দেয়া হয়।
আদালত আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে পি কে হালদারকে অপসারণ করে কোম্পানিটি পরিচালনার জন্য স্বাধীন পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দেন। আইএলএফএসএলের ৭ বিনিয়োগকারীর টাকা ফেরত চেয়ে করা মামলার শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ আদেশ দেন।
পিকে হালদার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি কোটি কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে পালিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে ইন্টারনাশনাল লিজিং কোম্পানি আপিলে যায়।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) স্বাধীন চেয়ারম্যান (হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত) খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের নিচে নয় এমন একজন কর্মকর্তাকে আসতে বলেন আপিল বিভাগ। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বাস্তবিক পক্ষে অর্থনৈতিক অবস্থা কী রকম আছে, অবসায়ন হওয়ার মতো অবস্থায় আছে কিনা, আর্থিক অনিয়ম হলে কোন্ পর্যায়ে আছে, অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয়ে সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তানজিব-উল আলম।আর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম।
মঙ্গলবার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ও শাহ আলম লিখিত আকারে মত তুলে ধরেন। আদালত নিয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খন্দকার ইব্রহীম খালেদ আদালতে বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটড খুবই ভালোমতো চলছিল। ২০১৬ সাল থেকে এর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এর পেছনে ‘কি পারসন’ (মুখ্য ব্যক্তি) হিসেবে কাজ করেছেন পি কে হালদার। তার সঙ্গে আরও অনেকেই রয়েছে। এরা একসঙ্গে অনেক শেয়ার কিনে কোম্পানিটির আগের নেতৃত্বকে বের করে দিয়েছেন। বের করে দেয়া মানে কাউকে চাকরিচ্যুৎ করা হয়েছে, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে অথবা ছাঁটাই করা হয়েছে।
পিকে হালদারসহ কিছু ব্যক্তি এই কোম্পানি থেকে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তা লেখা আছে। তলিয়ে দেখতে অনুমতি দেয়া হয়নি। এই টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। টাকা কোথায় আছে সেটা আনট্রেসেবল (হদিস পাওয়া যাচ্ছে না)। দেশেও থাকতে পারে দেশের বাইরেও যেতে পারে। তবে এই টাকা উদ্ধার করতে রিকোভারি অ্যাজেন্ট নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের অ্যাজেন্ট দিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ ডেপুটি গভর্নর বলেন, পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করা হয়েছে। এখন যদি একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটডকেও অবসায়ন করা হয় তাহলে আর্থিক খাতে ধস নামতে পারে। আবার এ অবস্থায় এটাকে কতটা দাঁড় করানো যাবে সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। আমি সাহস পাচ্ছি না। আমি তো এই কোম্পানির কোনো শেয়ারহোল্ডার নই। হাইকোর্টের আদেশে আমাকে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান করা হয়েছে। বাইরে থেকে এসে আমি এটাকে কতটা দাঁড় করাতে পারব! শর্ষের মাঝে ভূত থাকলে আমি কি করতে পারি! তখন প্রধান বিচারপতি কোম্পানিটির আমানতকারীদের অবস্থা জানতে চাইলে ইব্রাহীম খালেদ বলেন, টাকা তো নেই। তারা চাইলেও টাকা ফেরত দেয়া যাচ্ছে না। পয়সা তো নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন