আবারও ফিরে এসেছে শোকাবহ সেই ২৫ ফেব্রুয়ারি, দেশের ইতিহাসের কলঙ্কময় এক অধ্যায়। বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের ১১ বছর পূর্ণ হলো আজ। বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) কথিত কিছু বিপথগামী সদস্য দাবি-দাওয়ার নামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে পিলখানায় নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে মহাপরিচালকসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহত হয় নারী ও শিশুসহ আরও ১৭ জন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রী, বাসার কাজের মেয়ে ও বেড়াতে আসা আত্মীয়রাও।
ইতিহাসের সেই বিভীষিকাময় দিন নারকীয় হত্যকাণ্ডের মামলার বিচারকাজ চলছে দুই ভাগে। হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে। দীর্ঘ বিচার ও রায় শেষে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে হাইকোর্ট। আর বিস্ফোরক আইনের মামলায় এখনও শুনানি চলছে।
পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ আপিল বিভাগে চূড়ান্ত আপিল করবে। এটি নিষ্পত্তি হলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির মঞ্চে নিতে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে রিভিউ ও রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়ও সুরাহা হতে হবে। রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যাশা- জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ডে হাইকোর্টের দেওয়া রায় সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকবে। এ ছাড়া বিস্ম্ফোরক আইনে করা আরেকটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালতে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছাড়াও আরও ৪২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়। ৮ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়।
নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়। খালাস পান ১২ আসামি। নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ যে আপিল করেছিল, তার মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট।
সেদিনের ঘটনা
২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯, সকাল ৯টা ২৭ মিনিটের দিকে বিজিবির বার্ষিক দরবার চলাকালে দরবার হলে ঢুকে পড়ে একদল বিদ্রোহী সৈনিক। এদের একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারটি প্রবেশ গেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশেপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকে তারা।
বিদ্রোহীরা দরবার হল ও এর আশপাশ এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের গুলি করতে থাকে। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে পিলখানা থেকে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিজিবি সদস্য ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।
ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ম্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়। ২০১০ সালের ১২ জুলাই পিলখানা হত্যা মামলায় ৮২৪ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে সম্পূরক চার্জশিটে আরও ২৬ জনকে আসামি করা হয়। পিলখানা হত্যা মামলার ২৩৩তম কার্যদিবসে মামলায় ১২৮৫ জনের মধ্যে ৬৫৪ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছরের ২২ আগস্ট অভিযোগ গঠন করা হয়।
পিলখানা বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা সব বিদ্রোহ মামলার বিচার শেষ হয়েছে। ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর সদর রাইফেলস ব্যাটালিয়নের ৭২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ মামলার বিচার শেষ হয়। বিদ্রোহের ঘটনায় ১১টি বিশেষ আদালতে ৬ হাজার ৪৬ জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এদের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে ৫ হাজার ৯২৬ জনের। খালাস পান ১১৫ জন। পিলখানা বিদ্রোহের পর বিডিআরের নাম, লোগো, পতাকাও পরিবর্তন করা হয়।
ব্রেকিংনিউজ/
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন