নীতিমালা লঙ্ঘন করে কোটি কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে সময়ের আগেই ব্যাপকহারে শিক্ষক বদলির ঘটনায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পলিসি ও অপারেশন উইংয়ের তিন কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলির নির্দেশ দিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাকির হোসেন। গত ২৮ জানুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রতিমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। ওই আদেশে বলা হয়, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) খান মো. নুরুল আমিন, উপপরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) মির্জা হাসান খসরু ও শিক্ষা অফিসার (পলিসি ও অপারেশন) সেলিনা আক্তারের বিরুদ্ধে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ থাকায় জরুরিভিত্তিতে কম গুরুত্বপূর্ণ শাখায় বদলি করুন।’ এর আগে প্রাথমিক শিক্ষক বদলিতে এই ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্যের তথ্য তুলে ধরে গত ২০ জানুয়ারি সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজের ১৬ তম বর্ষের ১৩ তম সংখ্যায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘নীতিমালা লঙ্ঘন করে মন্ত্রীর অগোচরে ব্যাপকহারে প্রাথমিক শিক্ষক বদলি, কোটি কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর গোটা প্রাথমিক শিক্ষাখাতে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সাধারণ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রতিমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়ে বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট। শীর্ষ কাগজের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে এক সপ্তাহের মাথায় জড়িতদের শাস্তিমূলক বদলির আদেশ দেন প্রতিমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, এই বদলি কার্যক্রমগুলো হয় অত্যন্ত গোপনে, নিয়মনীতি চরমভাবে লঙ্ঘন করে এবং প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনকে একেবারেই আড়ালে রেখে। মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল-হোসেন এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি-পদায়নের সময় জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত। নিয়ম অনুযায়ী এর আগে বা পরে কেউ বদলির জন্য আবেদন বা তদবির করতে পারবেন না। আবেদন করলেও তা গ্রহণ করা হবে না। অতীতে বরাবর এই নীতিমালাই অনুসৃত হয়ে আসছে। অথচ এ বছর জানুয়ারি আসার আগেই সকল বদলি-পদায়ন সম্পন্ন করে ফেলা হয়েছে। নীতিমালা বা কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। এমনকি শুধু শূন্য পদেই নয়, ভবিষ্যতে অর্থাৎ আগামী ছয় মাসে যেসব পদ শূন্য হবে সেগুলোকে শূন্য ধরে বদলি-পদায়ন করা হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, মন্ত্রণালয়সহ গোটা প্রাথমিক শিক্ষা খাতে।
সূত্র জানায়, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. এএফএম মঞ্জুর কাদিরের চাকরির বয়স শেষ। আর সেই কারণেই তিনি পদে থাকাকালে কোনো নিয়ম-নীতি বা নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অত্যন্ত গোপনে আগাম এ কাজগুলো করে যান। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা। তবে মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আকরাম-আল-হোসেনেরও এতে যোগসাজশ রয়েছে। কিন্তু এই অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে প্রচণ্ডভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।
সূত্রমতে, মহাপরিচালক পদ থেকে অবসরের আগ মুহূর্তে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অন্তত তিন শতাধিক সহকারী শিক্ষক বদলি করে গেছেন ড. মঞ্জুর কাদির। এটা ওপেন-সিক্রেট যে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিজন সহকারী শিক্ষক বদলির জন্য ৭/৮ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। ঢাকার বাইরে দু’তিন লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়ে থাকে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) খান মো. নুরুল আমিন, উপপরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) মির্জা হাসান খসরু ও শিক্ষা অফিসার (পলিসি ও অপারেশন) সেলিনা আক্তারের সহযোগিতায় এই বদলি বাণিজ্য হয়েছে। এতে অন্তত কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
পলিসি ও অপারেশন শাখার তিন কর্মকর্তার মাধ্যমে এই অর্থ ভাগবাটোয়ারা হয়েছে। বদলির আবেদন ও প্রস্তাবের ফাইল উপস্থাপন থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পর্যন্ত হয়েছে ডিসেম্বরের তারিখে। তবে বদলির আদেশ জারি হয়েছে ১ জানুয়ারি, ২ জানুয়ারির তারিখ দিয়ে। যদিও এই বদলির আদেশগুলোও জারি হয়েছে ডিসেম্বরেই, যেহেতু ডিসেম্বরের তারিখে বদলির আদেশ জারি করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ, তাতে নীতিমালা সরাসরি লঙ্ঘিত হয়।
কিন্তু নীতিমালায় বলা আছে, জানুয়ারির আগে কারো কোনো বদলির আবেদন গ্রহণ করা যাবে না। অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বরে বদলির আবেদন গ্রহণ করে সেগুলোর প্রস্তাব অনুমোদন পর্যন্ত করা হয়েছে ডিসেম্বরের তারিখ দিয়ে। যা নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন