গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর হরিনাবাড়ী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ (আইসি) কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণের অভিযোগে মামলা না নিয়ে ধর্ষকের বাবা ও মাকে হাজতখানায় আটকে রেখে পুলিশ ফাঁড়িতে বসে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকায় দফারফা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আতিক, ধর্ষিতার ধর্ম পিতা হাবিজার ও পরিদর্শক কামাল হোসেন এবং এসআই কামাল উদ্দিন ধর্ষিতাকে নামে মাত্র টাকা দিয়ে বাকি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। এছাড়া আইসি কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক মাদক ব্যবসায়ী, ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি ও জুয়াড়িকে ধরে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের হরিনাবাড়ী গ্রামের দাশপাড়া এলাকার বিধবা ছদ্মনাম শ্রীমতিকে (২৫) বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিবেশী বাদশা মিয়ার (কবুতর বাদশা) ছেলে রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমান হাবু একাধিকবার ধর্ষণ করে। পরে হাবু বিয়ে করতে তালবাহানা করায় ধর্ষিতার ধর্ম পিতা প্রতিবেশী আব্দুল মজিদের ছেলে মহুবর ওরফে হাবিজারকে সাক্ষী করে পলাশবাড়ী থানায় গত বছরের ২৮ এপ্রিল ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগটি তদন্তসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অফিসার ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তাফিজ দেওয়ান হরিনাবাড়ী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের আইসি কামাল হোসেনকে দায়িত্ব দেন। যাহার অভিযোগ প্রাপ্তি রেজিস্টারের এসএল নম্বর ৩২২। অভিযোগ পেয়ে পরদিন রাতে আইসি কামাল হোসেন, এসআই কামাল উদ্দিন সঙ্গীয় ফোর্সসহ ওই বাড়িতে হানা দেয়। ধর্ষক হাবিবুর রহমানকে ধরতে না পেয়ে ধর্ষকের পিতা বাদশা মিয়াকে (৬৫) আটক করে তদন্ত কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। রাখা হয় হাজতখানায়। পরদিন সকাল আটটার দিকে বাদশা মিয়ার স্ত্রী হালিমা বেগম (৫৫) খাবার নিয়ে ফাঁড়িতে গেলে তাকেও হাজতখানায় রাখা হয়। এসময় তাদের ছেলে হাবিবুরকে হাজির করে না দিলে জেলহাজতে পাঠানোসহ নানা রকমের ভয়ভীতি ও হুমকি দেয় পুলিশ। এরপর শুরু হয় দফায় দফায় মিমাংসার আলোচনা।
এবিষয়ে বাদশা মিয়া বলেন, আইসি কামাল হোসেন প্রথমে মিমাংসা করে দেবে বলে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। এতে আমি রাজি না হলে এসআই কামাল উদ্দিন দশ পনের মিনিট পর এসে ৫০ হাজার টাকা কমিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা সংগ্রহ করতে বলেন। আমি এতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা আমার কাছে জমি লিখে চান। আমি এতে রাজি না হলে আমাকে বিভিন্ন মামলায় জেলহাজতে পাঠাবে বলে হুমকি দেন আইসি কামাল হোসেন। পরে মোশরারফ নামে আমার এক ভাই সুদের উপর দুই লাখ আর আমার বাড়িতে থাকা ৩০ হাজার টাকা একত্রে করে এই দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা আইসি কামাল হোসেনের হাতে দেয়। তিনি টাকাগুলো গুণে এসআই কামাল উদ্দিনের হাতে দেন। তারপর সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর স্টাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে হাজতখানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলে যদি অপরাধী হয়, দেশের প্রচলিত আইনে তার আমিও বিচার চাই। কিন্তু এই বুড়ো বয়সে আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে একদিন-একরাত হাজতখানায় আটকে রেখে চাপ দিয়ে পুলিশ দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা নিল, আমি এই পুলিশ কর্মকর্তাদের অপকর্মের বিচার চাই।
বাদশা মিয়ার প্রতিবেশী ভাই মোশারফ হোসেন বলেন, আগে জানতাম পুলিশ জনগণের বন্ধু। কিন্তু এখানে তার পুরোটাই উল্টো। হাবিবুর ধর্ষক, তাই ওর বিচার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পুলিশ ওর বিচার না করে হাবিবুরের বয়স্ক বাবা ও মাকে হাজতখানায় আটকে রেখে চাপ দিয়ে ধর্ষণ মামলা মিমাংসা করে দিল। সুদের উপর দুই লাখ এবং বাড়িতে থাকা ৩০ হাজার সহ মোট দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা আইসি হাতে বুঝে নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেন।
অভিযুক্ত হাবিবুর রহমান হাবু বলেন, আমি ওকে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক দিনের। কিন্তু সে তার ধর্ম পিতা হাবিজারের কুপরামর্শে থানায় ধর্ষণের অভিযোগ করে। তারপর আমাকে না পেয়ে আমার বয়স্ক পিতাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরের দিন আমার মা বাবার খাবার নিয়ে ফাঁড়িতে গেলে তাকেও হাজতখানায় রাখা হয়। পরে হাজতখানায় আটকে রেখে চাপ দিয়ে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়ে পুলিশ মিমাংসা করে দেয়।
ননজুডিশিয়াল স্টাম্পে উপস্থিত সাক্ষী হিসেবে এক নম্বরে স্বাক্ষর করেন ধর্ষিতার ধর্ম পিতা হাবিজার রহমান, দুই নম্বর সাক্ষী আ. রাজ্জাক, তিন নম্বরে মোস্তাফিজুর রহমান ও ৪ নম্বরে শ্রী কৃষনো চন্দ্র সরকার।
চার নম্বর সাক্ষী শ্রী কৃষনো চন্দ্র সরকার মুঠোফোনে বলেন, মামলা হলে উভয়পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ফাঁড়িতে বসে আইসির মধ্যস্ততায় উভয়পক্ষের মধ্য আপোষ-মিমাংসা করে দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা কি মিমাংসা যোগ্য? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিমাংসা যোগ্য কি না তা আমার চেয়ে পুলিশ ভালো জানেন। তবে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকেই ঘটনাটি মিমাংসা করে দেওয়া হয়।
ক্যাম্প ইনচার্জ পরিদর্শক কামাল হোসেন ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর দায়িত্ব হস্তান্তর করেন পরিদর্শক রাকিব হোসেনের কাছে। এরপর যোগদান করেন গাইবান্ধা এ সার্কেল অফিসে। বর্তমানে তিনি সেখানে কর্মরত থেকে নোয়াখালীতে ট্রেনিংয়ে আছেন। এবিষয়ে তার বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই ঘটনার সাথে আমি জড়িত নই। ঘটনাটি ঘটিয়েছেন এস আই কামাল উদ্দিন। তিনি বর্তমানে পলাশবাড়ী থানায় কর্মরত আছেন।
জানতে চাইলে এসআই কামাল উদ্দিন মুঠোফোনে এবিষয়ে কোন কথা বলতে চাননি। এবিষয়ে পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন