সুনামগঞ্জ-১ আসনের বিতর্কিত এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের আশীর্বাদে ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর থানা আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন তালুকদারের হাতে যেন আলাদিনের চেরাগ।
নিু মধ্যবিত্ত পরিবারের মোবারক মাত্র কয়েক বছরেই এখন কোটিপতি। তিনি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার রঘুরামপুরের ‘একদিল মোড়ল’ রাজাকারের নাতি (মেয়ের ছেলে)। এমপি রতনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে মধ্যনগর থানা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি হন মোবারক। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এমপির প্রভাব খাটিয়ে তিনি থানা পুলিশে তদবির, টিআর-কাবিখায় ভাগ, জলমহাল দখল ও ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িয়ে অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।
রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া মোবারকের পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে ময়মনসিংহ শহরে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর বাজারে তার রয়েছে তিনটি পাকা বাড়ি। সবক’টিই গড়ে তুলেছেন সরকারি জায়গায়। তার ব্যাংক হিসাবে রয়েছে লাখ লাখ টাকার লেনদেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানের বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৮ সালে আগে রাজনীতিতে তেমন একটা সক্রিয় ছিলেন না ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল আজিজ তালুকদারের ছেলে মোবারক হোসেন। ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ নির্বাচিত হন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। এর পরই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন মোবারক। মিছিল-মিটিংয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকা শুরু করেন। ফুট-ফরমায়েশ খেটে অল্প দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। অষ্টম শ্রেণি পড়–য়া কৃষক মোবারক এমপি রতনের সংস্পর্শে পেয়ে যান অদৃশ্য ক্ষমতা।
তিনি এখন মধ্যনগর থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির এক নম্বর সদস্য ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী। রাজাকার পরিবারের সন্তান হয়েও আওয়ামী লীগের থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হতে কতিপয় অসৎ আওয়ামী নেতার পেছনে টাকা-পয়সা ঢালছেন মোবারক। অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী (এনআইডি নং ১৯৭১৯০১৩২৫৭৩৯৯২৩৯) মোবারক পেশায় কৃষক। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের মধ্যনগর শাখায় তার হিসাব নম্বর ৫৯০৭২০০০০০৪৪৪-এ ২০১৭ সাল থেকে চলতি মাস পর্যন্ত প্রায় ৭০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। রয়েছে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টও।
মোবারকের রাতারাতি এমন ভাগ্য পরিবর্তনে এলাকাবাসীও বিস্মিত। এমপি রতনের ছত্রচ্ছায়ায় মধ্যনগর বাজারের সরকারি জমি, খাল দখল করে গড়ে তুলেছেন ৩টি অট্টালিকা। মধ্যনগরে কান্দাপাড়া ও নোয়াপাড়ার মধ্যবর্তী এলাকার একটি বড় খাল দখল করে নির্মাণ করেছেন পাকা বাড়ি।
কান্দাপাড়া গ্রামে নিজের বাড়ি ও ফসলি জমি থাকার পরও এমপি রতনের প্রভাব খাটিয়ে ২০১২ সালে ভূমিহীন হিসেবে মধ্যনগর পোস্ট অফিস ও ভূমি অফিসের মধ্যবর্তী স্থানে সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে লিজ নিয়ে ‘সখিনা ভিলা’ নামে গড়ে তুলেছেন দুই তলা বাড়ি। একই বছর মধ্যনগর থানার সামনে জনৈক মিনা দে’র সরকারি লিজ জমি জোরপূর্বক জবরদখল করে সেখানে নির্মাণ করেছেন দুই তলা দালান। স্থানীয় হিন্দু পরিবারগুলো মোবারকের নির্যাতন নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন। শুধু এখানে শেষ নয়, ক্ষমতা ও টাকার গরমে মোবারক এখন বেপরোয়া। তার হাত থেকে রক্ষা পাননি পুলিশের ডিআইজি বাতেনের ভাতিজাও। কিছুদিন আগে ডিআইজি বাতেনের ভাতিজাকেও মারধর করেন মোবারক।
দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, গত উপজেলা নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মনোনীত প্রার্থী শামীম হোসেন মুরাদের সরাসরি বিরোধিতা করে এমপি রতনের ভাই রোকনকে নির্বাচিত করতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন মোবারক। এ মোবারক নিজেসহ তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপি-জামায়াত সরকারের সাবেক এমপি নজীর হোসেনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। চাচাতো ভাই বিএনপি নেতা আবদুল কাইয়ুম মজনুর মাধ্যমে সাবেক এমপি নজিরের সঙ্গে গভীর সখ্য ও ব্যবসায়িক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন মোবারক।
মোবারক জোরপূর্বক মধ্যনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কমিটির সভাপতির পদ দখল করে নানা অনিয়ম দুর্নীতি ও বদলি বাণিজ্যে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছুদিন আগে তার মদদে এ স্কুলের দফতরি প্রধান শিক্ষককে মারধর করে। স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ আছে মোবারকের বিরুদ্ধে। এছাড়া মধ্যনগর বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও নিয়মিত মোটা অংকের মাসোহারা নেন তিনি। এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের জন্য মোবারকের নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। মধ্যনগর বিপি উচ্চ বিদ্যালয়ের চাঞ্চল্যকর মিনতি হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ধর্মপাশার এক জনপ্রতিনিধি যুগান্তরকে জানান, কৃষক পরিবারের ছেলে মোবারক এমপি রতনের সংস্পর্শে আসার আগে বছরের অধিকাংশ সময়ই বেকার থাকত। মাঝেমধ্যে কৃষি কাজ করত। রতন এমপি হওয়ার পর রাতারাতি সে কোটিপতি বনে যায়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোবারক হোসেন তালুকদার বলেন, মধ্যনগরের মানুষ আমার পরিবার সম্পর্কে জানে। বাবা আওয়ামী লীগ করতেন। আমিও স্কুল জীবন থেকে ছাত্রলীগ করে আওয়ামী লীগে এসেছি। নানা রাজাকার ছিলেন কিনা এখনও জানি না। ব্যাংকে টাকা আছে কিনা তা খোঁজ নিলেই জানা যাবে। তিনি বলেন, ‘আমরা পাঁচ ভাই। একজন ব্যাংকে চাকরি করে। বাকিরা ব্যবসা করি।’ ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য অনুযায়ী তো আপনি পেশায় কৃষক- এমন প্রশ্নের উত্তরে মোবারক বলেন, কৃষির সঙ্গে ব্যবসাও রয়েছে। ঠিকাদারি লাইসেন্সও আছে।’ সরকারি জমিতে দালান গড়ে তোলার বিষেয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো রটনা। প্রতিহিংসাবশত কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে।’
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। এনিয়ে মন্তব্য করব না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন