ভূমিদস্যু হিসাবে আবেদ-জাবেদ দুই ভাইয়ের নাম এখন সবার মুখে মুখে। সর্বশেষ পুরান ঢাকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সম্পত্তি দখল করতে গিয়ে বাধা পান। তাদের সহযোগিতা করতে গিয়ে চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত হন পুলিশের ডিসি। এক ভাই বিএনপি নেতা জাবেদ গ্রেফতার হয় কিন্তু এর আগে একের পর এক সরকারের অতি মূল্যবান সম্পত্তিগুলো দখল করে নিয়েছেন। কোথাও কোনো বাধাই তাদের পেতে হয়নি। বরং তাদের এ অবৈধ কাজে সহযোগিতা করছে ঢাকার জেলা প্রশাসন।
জানা গেছে, ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কিছু পদস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারী, স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মচারী, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে এই দুই ভাই গড়ে তুলেছেন বিশাল এক শক্তিশালী ভূমি খেকো সিন্ডিকেট। সংশ্লিষ্ট অফিসে যে কর্মকর্তা পোস্টিং হয়ে আসেন তাকেই তারা হাত করে ফেলেন মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে। অর্থের লোভ সামলাতে না পেরে সরকারি অর্পিত সম্পত্তি দখলে সহযোগিতা করেন কর্মকর্তারা। বিশেষ করে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয় বরাবর এই দুই ভূমিদস্যু ভাইয়ের হাতের মুঠোয় থেকেছে এমন অভিযোগ তুলছেন পুরান ঢাকার সাধারণ মানুষ।
এই দুই ভাই অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে সরকারি সম্পত্তি দখল করে তৈরি করেছেন উচু উচু অট্টলিকা ও মার্কেট। সরকারি সম্পত্তি দখল করে নিজেরাই জমির মালিক, আবার নিজেরাই ডেভেলপার সেজেছেন। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করেছেন। ভুয়া কাগজপত্রে মামলা করে স্থিতিঅবস্থা এনে সেই প্লটের উপরই অট্টালিকা নির্মাণ করে বিক্রি করে দিয়েছেন। ঢাকা জেলা প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে উল্টো এদের অপকর্মে সহযোগিতা করেছে। জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় সবই এদের অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে আছে। যে কারণে ভুয়া কাগজপত্রে বছরের পর বছর মামলা ঝুললেও সেই মামলার কোনো সুরাহা হয় না। রাজনৈতিকভাবে দুই ভাইয়ের একজন বিএনপি এবং আরেকজন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। ফলে যে দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকুক তাতে তাদের দখলবাজিতে কোনো সমস্যা হয় না। এভাবেই সরকারি জমির ওপর নির্মিত ভবন বিক্রির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, ২০১২ সালে সরকারি অর্পিত সম্পত্তির গেজেট প্রকাশ করে সরকার। নবাবপুর রোডের ২২২ হোল্ডিংয়ের গেজেটের ১২৪ নং ক্রমিকে উল্লেখ রয়েছে। এখানে সরকারের মোট ১২ শতাংশ সম্পত্তি রয়েছে। ইপি কেস নং ৮০/৬৯ এর মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে এই সম্পত্তিটি অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়। সেই থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে লিজ দিয়ে লিজ মানিও আদায় করছিল সরকার। ২০১২ সালে গেজেট প্রকাশিত হওয়ার সময় পর্যন্ত এটি সরকারের দখলে ছিল। ভূমি জরিপ অধিদফতরের রেকর্ডেও সরকারের অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে দেখা হয়। অথচ দুই ভাই ঢাকা জেলা প্রশাসনকে হাত করে জালিয়াতির মাধ্যমে এই জমি দখল করে নেন। এখানে থাকা একটি পাকা বাড়ি জোরপূর্বক ভেঙ্গে মরিয়ম টাওয়ার নামে একটি ভবন তৈরি করে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন।
ভূমি জরিপের গেজেটের ৯৩ নং ক্রমিকে উল্লেখ আছে নবাবপুর রোডের ২২৯ হোল্ডিংয়ের বাড়িটি। ১৯৬০ সালে ইপি কেস নং ৯০৬/৬০ এর মাধ্যমে সরকারের অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৭২ সালে এই জমি সরকার নিয়ন্ত্রণে নেয়। ২০১২ সালে গেজেটেও তা প্রকাশিত হয়। সাড়ে ৬ শতাংশ জমির উপর ছিল একটি পুরাতন বাড়ি। কিন্ত এই জলিয়াতি চক্র জোরপূর্বক জমি দখল করে। এখানে ড্রয়েলিং পয়েন্ট নামে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করে। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়।
নবাবপুর রোডের ৮৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে সম্পত্তিটি সরকারের অর্পিত সম্পত্তি। যার ইপি কেস নং ১৩০৮/৬৩। এখানে মোট দুইটি দাগে ১১ শতাংশ জমি। ২০১২ সালেও এই সম্পত্তিটি সরকারি সম্পত্তি হিসাবে গেজেট প্রকাশিত হয়। গেজেটে ৭১৭ ক্রমিকে নাম উল্লেখ আছে। কিন্তু কাগজপত্র সরকারের থাকলেও কৌশলে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যনেজ করে আবেদ-জাবেদ এই সম্পত্তিটি দখলে নেয়। এখানে পুরাতন ভবনটি ভেঙ্গে সাজেদা আলী প্লাজা মার্কেট নির্মাণ করে। অতঃপর বিক্রির মাধ্যমে এখান থেকে অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
নবাবপুরে রোডের ৫৫/৫৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের সম্পত্তিটির মালিক সরকার ১৯৬৮ সাল থেকে। ইপি কেস নং ১৮৮/৬৮ এর মাধ্যমে ওই সময় এটি সরকারি অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভূক্ত হয়। এই সম্পত্তিটি সরকার ২৯ মার্চ ১৯৮৩ দখলে নেয়। ভূমি অফিসের সরকারি সম্পত্তি হিসাবে ২০১২ সালের গেজেটেও প্রকাশিত হয়। জাবেদ-জাবেদ জেলা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জাল কাগজপত্র তৈরি করে এবং এই জমির উপর থাকা পুরাতন ভবন ভেঙ্গে নবাবগঞ্জ কমার্সিয়াল নামে বহুতল ভবন নির্মাণ করে।
নবাবপুর রোডের ২৩৪ এবং ২৩৫ হোল্ডিং এর সম্পত্তিটি দখল করে জাবেদ-আবেদ। জাল ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অতি মূল্যবান সম্পত্তিটি দখল করে এর উপর জাবিন টাওয়ার নামে বিশাল ভবন নির্মাণ করে। পরে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে।
নরেন্দ্র বসাক লেনের ৫০ নম্বর হোল্ডিংয়ের সরকারি মালিকানাধীন অর্পিত সম্পত্তি দখল নেয় আবেদ-জাবেদ। সর্বশেষ ২০১২ সালের সরকারি সম্পত্তি হিসাবে এই সম্পত্তিটি গেজেটে প্রকাশিত হয়। গেজেটের ৯৩৯ ক্রমিক নম্বরে তা উল্লেখ রয়েছে। গেজেটে বলা হয়, ইপি কেস নং ২৫/৬৮ এর মাধ্যমে ১৯৬৮ সালে অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে সরকার দখলে নেয়। তখন থেকে জমিটি সরকারে মালিকানাধীন ছিল। জেলা প্রশাসন এই সম্পত্তি লিজ দিয়ে লিজ মানিও আদায় করে আসছিল। কিন্তু সেই সম্পত্তিটি আবেদ-জাবেদ জেলা প্রশাসনকে হাত করে ভুয়া কাগজ-পত্রে দখল করে নেয়।
সরকারি অর্পিত সম্পত্তি দখলদারিত্বের অংশ হিসাবে আবেদ-জাবেদ ২০১৬ সালে পুরান ঢাকার নবাবপুরে ৬৮ নং রোডের সাব-পোস্ট অফিস দখল করে। এই সময় বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসনকে অবিহিত করা হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সেই সময় জেলা প্রশাসন কার্যালয়কে বরাবরের মতই নির্লিপ্ত ভূমিকায় দেখা গেছে। যদিও শীর্ষ কাগজসহ বেশ কয়টি সংবাদপত্রে দখলের ঘটনাটি প্রকাশিত হবার পর সমালোচনার মুখে সেই জমি উদ্ধার করে প্রশাসন।
সরকারি সম্পত্তি দখলে একেক জমিতে একেক কৌশল গ্রহণ করে জাবেদ-আবেদ। তার মধ্যে সূত্রাপুরে আরএস দাস রোডর(ভূষির গলি) ৮৮, ৯৬, ৯৭ নং হোল্ডিংয়ে ৩২ কাঠা জমি আসাদ মাহবুব ও দিপু মাহবুব দুই ব্যক্তির নাম ভাঙ্গিয়ে দখল করে। পরে সেখানে থাকা পুরানো বাড়ি ভেঙ্গে বহুতলা ভবন নির্মাণু করে। সেখান থেকেও হাতিয়ে নেয় অর্ধশত কোটি টাকা।
সাম্প্রতি পুরান ঢাকার নবাবপুরের ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া শামসুল হক খানের পরিবারের কাছ থেকে ৪ কাঠা জমি দখল করেছে এই চক্র। ভূক্তভোগী পরিবারটির দাবি, এই দখলে ওয়ারির ডিসি (পুলিশ) ইব্রাহিম খান জাবেদ উদ্দিন ও আবেদ উদ্দিনকে বাড়ি দখলে শুধু ম্যানেজ করেননি, ঢাকা জেলা প্রশাসক ফেরদৌস খানকেও ম্যানেজ করেছেন যাতে বাড়ির জমির মালিকানা শহীদ পরিবারের নামে না যায়। ৩ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ওয়ারী জোনের ডিসি ইব্রাহিম খান সাময়িক বরখাস্ত করা হলে পরিবারটি বলেন, এতে তারা খুশি হলেও জমির মালিকানা বুঝিয়ে না পাওয়া ও বাকি আসামিদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো লাভ নেই। তাই তারা জমির মালিকানা বুঝিয়ে নেওয়া ও সেখানে ভবন করার অনুমতি চেয়েছেন।
প্রতিটি প্লট দখল ও মার্কেট নির্মাণ নিয়েই জাবেদ-আবেদর বিরুদ্ধে মামলা চলছে। কিন্তু আদালতের স্থিতাবস্থার আদেশ নিয়ে তারা ভবনের নির্মাণকাজ চালিয়ে যান। এসব প্রতি কাঠা জমির বাজারমূল্য দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা। প্রতিটি মার্কেট থেকে বছরে ভাড়া উঠছে কোটি কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ ভাবে উর্পাজনের একটি অংশ পাঠানো হচ্ছে পুলিশসহ রাজনৈতিক নেতাদের হাতে।
এমনও অভিযোগ আছে, এই ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। একটি ঘটনায় দেখা গেছে, অভিযানের অংশ হিসাবে ম্যাজিস্ট্রেট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দখলদারদের প্রয়োজনীয় কাগজ দেখাতে বলেন, অন্যথা আইন আনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন। কিন্তু মাস যায় বছর যায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ঢাকা জেলা প্রশাসক অফিসের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারী এবং ক্ষমতাশীন দলের কিছু প্রভাবশালীকে ম্যানেজ এবং ঘুষ লেনদেনের জোরেই নাকি তারা এভাবে জালিয়াতির কাজ নির্বিঘেœ চালিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সরকারি সম্পত্তি জোর করে দখলের ব্যাপারে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে লিখিত ও মৌখিকভাবে অভিযোগ করতে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভ্রুক্ষেপই করেন না, বরং তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাবই পরিলক্ষিত হয়।
সরকারি অর্পিত সম্পত্তি একের পর এক বেদখল হয়ে যাচ্ছে এই অসাধু সিন্ডিকেটের হাতে। আর এই ভাবে সকলকে ম্যানেজ করে প্রশাসনের নাকের ডগায়ই এমন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে আবেদ জাবেদ। অথচ বেদখল জমি উদ্ধারে ঢাকার জেলা প্রশাসনের কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এ কার্যালয়ের বেশির ভাগ কর্মকর্তা কৌশলে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এই সব ভূমিদস্যুদের হাত থেকে সরকারি সম্পত্তি যদি রক্ষা করা না যায় তাহলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। যত দ্রুত সম্ভব এই ভূমিখেকোদের আইনের আয়োতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কোন ব্যক্তি আইনের অপব্যবহার করে সরকারি সম্পত্তি দখলে সাহসিকতা না দেখায়। সেই সঙ্গে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের যেসব অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী ও স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মচারী এই দুই ভাইকে সরকারি জমি দখলে সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ২৮ অক্টোবর ২০১৯ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন