আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা নতুন রূপে দেখছি। তিনি দুর্নীতি আর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে খুব কঠোর অবস্থানে চলে গেছেন তা উনার বিগত কয়েকদিনের কর্মকাণ্ডেই বুঝা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- ‘কাউকে ছাড় নয়, সবার আমলনামা আমার হাতে’। সেই ‘আমলনামা’য় কী কী আছে তা সব জানা না গেলেও কিছু কিছু জানা যায় বিভিন্ন সূত্রে। তা থেকে কিছু তথ্য নিয়ে এবার আমরা বিভিন্ন সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ির যে অপব্যবহার আর লুটপাট হচ্ছে তার কিছু তথ্য আমাদের কাছে বিভিন্ন সূত্রে এসেছে।
বাংলাদেশ এখন নানামুখী উন্নয়নের কর্মযজ্ঞের জোয়ারে ভাসছে, দেশের অর্থনীতি হচ্ছে শক্তিশালী, একই সাথে ভরছে মানুষের ব্যক্তিগত পকেট। উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে অক্টোপাসের মত আমাদের ঝাপটে ধরছে দুর্নীতি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছে কিছু সৎ আমলা আর কিছু সৎ রাজনৈতিক কর্মী নিয়ে। উন্নয়নের কারণে দেশে শিল্প কারখানা বাড়ছে, বাড়ছে সেবা, পরিসেবা খাত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋণের টাকায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারী বিভিন্ন দপ্তরে আনা হচ্ছে উন্নত যন্ত্রপাতি, নানা রকমের দামী যানবাহন, ইত্যাদি। তাই এই দফায় যন্ত্রপাতির কথা বাদ দিয়ে শুধু গাড়ি নিয়ে কী তুঘলকী হচ্ছে বিভিন্ন সূত্রের বরাতে তার একটা বাস্তব ছবি আঁকার চেষ্টা করা যেতে পারে।
দীর্ঘদিন থেকেই সরকারি গাড়ি ব্যবহারে অনিয়মের বিষয়টি বহুল আলোচিত। যারা বয়স্ক তাঁরা জানেন যে, এখন গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখে আর বোঝা যায় না কোনটা সরকারী আর কোনটা বেসরকারি গাড়ি। আগে সরকারী গাড়ির নং প্লেটের রং ছিলো লাল, কর্পোরেশনের গাড়িগুলোর নং প্লেটের রং ছিলো নীল কিংবা সবুজ আর বেসরকারি গাড়ির নং প্লেটের রং ছিলো কালো। ছুটির দিনে, গভীর রাতে বিভিন্ন স্থানে সরকারী গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে বা আত্মীয় বন্ধু কিংবা প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য ব্যবহার হতো। বেরসিক সাংবাদিক এসবের ছবি তুলে পত্রিকায় দেদারসে ছাপানর ফলে বিব্রত সরকারী কর্মকর্তাগণ গাড়ির নং প্লেটের রং কালো করে ফেললেন যাতে সহজে চেনা না যায়। এখনো বিভিন্ন মিডিয়ায় সরকারী গাড়ির ব্যবহারে অনিয়মের বিষয় নিয়ে খবর ছাপা হচ্ছে। বিদ্যমান সরকারী আইন অনুযায়ী কোন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানে ৬০ দিনের মধ্যে ঐসব প্রকল্পের গাড়ি সরকারের পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার কথা, কিন্তু তা হচ্ছে না। এ বিষয়ক অনিয়মের কারণে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় রেলের ডিজেল বস্তায় ভরে বিক্রি হয় তার খবর আর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই দেখেছেন। জেনেছে কী করে ফেরিঘাটে আর বিভিন্ন রেলওয়ে জংশনে প্রতি বছর কিছু তেল চোর আর তার সহযোগীরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমরা সেসব খবরে না গিয়ে শুধু প্রকল্পের ঋণের টাকায় কেনা গাড়িগুলো নিয়ে কী মহা অনিয়ম আয় অপচয়, লুটপাট হচ্ছে তা জানার চেষ্টা করবো।
যে কোন গাড়ির ইঞ্জিনের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী গাড়ির মাইলেজ হিসেব করা হয়। মানে ১ লিটার তেলে কত কিলোমিটার চলবে সেটা। এর একটা গড় হিসেব আছে। গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও বলা থাকে ঐ মডেলের গাড়ির মাইলেজ কত হবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে সাধারণত জীপ টাইপের গাড়ি মানে আমরা যাদের ব্র্যান্ড নাম মিতসুবিসি পাজেরো, বা টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, ইত্যাদি বলি সেই টাইপের গাড়ি কেনা হয়। এসব গাড়ির মাইলেজ ঢাকা শহরে দিন ও সময় ভেদে থাকে গড়ে প্রতি লিটারে ৭ বা ৮ কিলোমিটার। কারণ জ্যামের কারণে ঢাকা শহরে গাড়ির গড় গতি এখন মাত্র ৭ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বা এর কাছে, যেটা ২০০৭ সালেও ছিল ২১ কিলোমিটার / ঘণ্টা কিন্তু ঢাকার বাইরে দিন ও সময় ভেদে লিটারে থাকে ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে প্রায় সব প্রকল্পের গাড়ির মাইলেজ দেখানো হয় লিটারে ৫ কিলোমিটার। যার থেকে মাসে শত শত লিটার তেল চুরি করা হয়, সবার পরোক্ষ অনুমোদনে! এই তেলের ভাগ পায় সংশ্লিষ্ট ড্রাইভার আর গাড়ি ব্যবহারের অধিকারপ্রাপ্ত অফিসারের বউ, ছেলে, মেয়ে এমনকি সন্তানদের তাঁদের বয় ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডরা। সাথে প্রতি মাসে কম করে হলেও ১৫০ থেকে ২০০ ঘণ্টা ওভার টাইম বিল ড্রাইভারের। এই গাড়ির বাইরেও ছুটির দিনে প্রকল্প কর্মকর্তাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজনদের ঘোরা বা ভ্রমণের জন্য প্রকল্পের অন্য গাড়ি ব্যবহার করা হয়। এর জন্য দেওয়া হয় টিএ/ডিএ বিলও ড্রাইভারকে।
একটা ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তার জন্য প্রকল্পের ঋণের টাকায় গাড়ি কিনে দেওয়া হলেও তিনি সাধারণত আরও একটা প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করেন তাঁর পরবারের জন্য, যার বিল দেওয়া হয় প্রকল্প থেকে, কাজ করেন বাসায় পরিবারে। এটা কিন্তু প্রকল্পে নিয়োজিত সহায়কদের বাসায় রান্না বা ক্লিনারের কাজ করানোর বাইরে। যা হোক, সরকার অনেক প্রকল্পের গাড়িতেই ভেইকেল ট্রাকার লাগিয়েছে। এতে রেকর্ড থাকে গাড়ি কখন কোথায় গেল থাকলো ইত্যাদি। প্রতিটি গাড়ির তেলের বিল, ড্রাইভারের ওভারটাইম বিল আর প্রতি মাসের ভেইকেল ট্রাকার রেকর্ডগুলো পরীক্ষা করলেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে। এর জন্য লক্ষ টাকা ব্যয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা লাগবে না। তবে এটা আচমকা না করলে রেকর্ড রুমে আগুন লাগবে, কিংবা উইপোকা ধরবে অথবা বৃষ্টির পানি বা অফিসে কানেকশন নেওয়া ওয়াসার পাইপ লাইনে ছিদ্র হয়ে পানিতে অনেক ডকুমেন্ট নষ্ট হয়ে যাবে। সিনিয়র সহকর্মীদের দিয়ে তদন্ত কমিটি হবে। তাতে বলা হবে ‘ঘটনা, সত্য, সাক্ষ্য প্রমাণ দুর্বল, আসামী খালাস’ এর মত ঘটনা।
সরকারী প্রকল্পের গাড়ির মেইন্টেনেসের নামে চলে আসল ডাকাতি। প্রতি ৩ মাস বা ৩০০০ কিলোমিটার চলার পরে (যেটা আগে আসে) গাড়ির ইঞ্জিন ওয়েল, ফিল্টার, ইত্যাদি পরিবর্তন করার নিয়ম। নিয়ম মেনে কাগজে কলমে তা পরিবর্তিত হয়। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। প্রতি ৩ মাস পরে একবার বিল আসে কিন্তু ইঞ্জিন ওয়েল, ফিল্টার, ইত্যাদি পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন হয় ৬ মাস পরে। ফলে নতুন গাড়ি ২/৩ বছর পরেও পাঠাতে হয় মোটর ওয়ার্কশপে, রিপেয়ারের জন্য। বিআরটিএ রিপোর্টের ভিত্তিতে ৩ টা মোটর ওয়ার্কশপ থেকে কোটেশন নেওয়া হয়, বিশেষ আয়োজন করে। গাড়ি রিপেয়ারের নামে চলে লুটপাটে মহাযজ্ঞ। ১০ হাজার টাকার কাজ হয় লাখ টাকায়। গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সব গবেষণা মিথ্যা প্রমাণ করে কয়েক বছরেই প্রকল্পের গাড়ি হয়ে যায় কন্ডেমড বা ব্যবহার অনুপযোগী। এসব হয় নতুন টায়ার কিনে পুরাতন টায়ার লাগানোর বাইরে, কারণ টায়ার বিক্রি প্রকল্পের গাড়ির অপব্যবহারের একটা খুব ক্ষুদ্র কম্পোনেন্ট।
বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের অধীন বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের কর্মকর্তাগণ সব জেনেও চুপ থাকেন তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থে। কারণ গাড়িতে হয় অনেক লেনদেন, কিংবা লীলাখেলা, যা ড্রাইভার সাহেব জেনে যান। অবৈধ টাকার সাথে অবৈধ কাজের নিবিড় সম্পর্ক থাকে। বৈধ পথে টাকা খরচ সহজ নয়। ড্রাইভার সাহেব অনেক ঘটনার সাক্ষী। তাই অসময়ে অচেনা বা নীরব কোন স্থানে কোন যুবক যুবতী বা বৃদ্ধের সাথে কোন অত্যাধুনিক তরুণীর উষ্ণ সান্নিধ্যের দৃশ্য আর পাশে দামী গাড়ি মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওটা সরকারী প্রকল্পের কোন গাড়ি। অনেকে তাদের পরকীয়া প্রেমিকাকেও ফুল টাইম প্রকল্পের গাড়ি দিয়ে রাখেন, এমন অভিযোগ ইদানিং খুব কম নয়। তাই আগের মত সরকারী মালিকানাধীন গাড়ির নং প্লেট আবার আগের মত লাল আর সবুজ বা নীল রঙয়ে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে গভীরভাবে চিন্তা করা হচ্ছে। সেই সাথে সরকারী ও সরকারী প্রকল্পের সব গাড়ীতে ভেইকেল ট্রাকার লাগানো, আর ট্রাকারের ডিজিটাল তথ্য মাসে মাসে একাধিক স্থানে জমাদান বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত আসতে পারে যে কোন সময়। এতে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম কমে যেতে পারে। কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হবে দেশের তথা সরকারের।
বাংলা ইনসাইডার
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন