সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর ডিপো (সিএমএসডি) বা কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের কর্মকর্তারা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে কম্পিউটার ক্রয়ের নামে সরকারের ১৪ কোটি ৩১ লাখ ৪৭ হাজার টাকার বেশি লোপাট করেছেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। বিদেশি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কথা বলে এর পরিবর্তে দেশি প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খুলে এ অর্থ লোপাট করা হয়। এ ছাড়া চুক্তিতে ইউএস অরিজিনের পণ্য আমদানির কথা থাকলেও চীনে তৈরি পণ্য আমদানি করা হয়েছে যে বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
সিএমএসডি ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান যোগসাজশ করে এসব দুর্নীতি করেছে। কিন্তু বিষয়টি গোপন থাকেনি। ২০১৪ সালের অডিটে মালামাল আমদানির নামে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি ধরা পড়ে। আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি অবহিত করতে
২০১৪ সালে ৮ এপ্রিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়। এর পরই বিষয় উত্থাপিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ৭ম বৈঠকে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, সিএমএসডি ও সিভিল অডিট বিভাগ একত্রে বসে নথিপত্র যাচাই-বাছাই শেষে পিএ কমিটিকে অবহিত করতে হবে।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. রুস্তম আলী ফরাজীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, অডিট অধিদপ্তর, সিএসএমডির কর্মকর্তারাও অংশ নেন। বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, সিএমএসডি কর্তৃপক্ষ ফরেন ফার্ম মেসার্স হাইলেট প্যাকার্ড লিমিটেডের (এইচপি) পরিবর্তে মেসার্স ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের নামে এলসি খোলেন এবং ফ্লোরা টেলিকমের নিজস্ব প্যাডে লোকাল কমার্শিয়াল ইনভয়েস তৈরি করা হয় যা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন করে। এইচপির ইনভয়েসে ৫৫ লাখ ২৯ হাজার ৯৪ মার্কিন ডলারের মালামাল আমদানির কথা উল্লেখ থাকলেও লোকাল কমার্শিয়াল ইনভয়েসের মাধ্যমে ৭৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫৩ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিল হিসেবে প্রদান করা হয়। এ ক্ষেত্রে সিএমএসডি কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৮৫৯ মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪ কোটি ৩১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করে যা প্রকৃতপক্ষে তারা লোপাট করে দিয়েছেন।
নথিপত্রের তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ৭ মে প্যাকেজ জি-এর আওতায় ১২ হাজার ৪৭১টি ল্যাপটপ এবং একই বছরের ১৩ মে প্যাকেজ জিডির আওতায় ৪ হাজার ৩৬০টি ডেস্কটপ ক্রয়ের জন্য আইসিবি টেন্ডার আহ্বান করে। টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নের পর ইউএস অরিজিনের পণ্য ক্রয়ে প্যাকেজ জি-এর জন্য ৫২ লাখ ৭৫ হাজার ২৩৩ মার্কিন ডলার ও ইনল্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড আদার সার্ভিসেস খাতে খরচ ধরা হয় ৪২ লাখ ৪০ হাজার ১৪০ টাকা। প্যাকেজ জিডির পণ্য ক্রয়ে ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৭২০ মার্কিন ডলার ও ইনল্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড আদার সার্ভিস খাতে খরচ ধরা হয় ১৪ লাখ টাকা। এ মালামালগুলো ক্রয়ের জন্য সিঙ্গাপুরের হাইলেট প্যাকার্ড লিমিটেড ও এর স্থানীয় এজেন্ট মেসার্স ফ্লোরা লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিপত্র হয়। চুক্তিপত্র অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রায় পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রিন্সিপাল ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানির নামে এলসি খোলার কথা থাকলে স্থানীয় এজেন্ট মেসার্স ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের নামে এলসি খোলার সুপারিশসহ ওই প্রতিষ্ঠানের নামে বৈদেশিক মুদ্রা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয় সিএমএসডি। এর পর দুটি মূল এলসির বিপরীতে ৫২ লাখ ৭৫ হাজার ২৩৩ এবং ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৭২০ ডলারসহ মোট ৭৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫৩ মার্কিন ডলারে ১২ হাজার ৪৭১টি ল্যাপটপ এবং ৪ হাজার ৩৬০টি ডেক্সটপ আমদানির জন্য মেসার্স ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের অনুকূলে এলসি খোলা হয়। এলসি খোলার পর ৫৫ লাখ ২৯ হাজার ৯৪ মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে। কিন্তু ফ্লোরা টেলিকম আমদানিকৃত ৫৫ লাখ ২৯ হাজার ৯৪ মার্কিন ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব প্যাডে লোকাল কমার্সিয়াল ইনভয়েস তৈরি করে ৭৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫৪ মার্কিন ডলারের বিল জমা করে। এভাবেই পরস্পরের যোগসাজশে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা লুটপাট হয়।
নথিপত্রের তথ্যমতে, সিএমএসডি কর্তৃপক্ষ বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হাইলেট প্যাকার্ড লিমিটেড অনুমোদিত এজেন্ট মেসার্স ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেড ইউএসএ অরিজিনের পরিবর্তে চায়না অরিজিনের পণ্য আমদানি করে। এর পর আইসিডি কমলাপুর কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ফরেন ইনভয়েস প্রাইজের পরিবর্তে লোকাল কমার্শিয়াল ইনভয়েস প্রাইজের ওপর শুল্কায়ন দেখিয়ে পণ্য খালাস করে প্রকৃত আমদানি মূল্য অপেক্ষা অতিরিক্ত ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৮৫৯ মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেয়। ইনভয়েস পরিবর্তন করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি অডিটে ধরা পড়ে। এর পরই অর্থ লোপাটের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হয়ে চলে যায় জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কাছে। যারা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে অর্থ আদায় করার নির্দেশ দেয় স্থায়ী কমিটি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, সিএমএসডি ও সিভিল অডিট বিভাগ একত্রে বসে নথিপত্র যাচাই-বাছাই শেষে পিএ কমিটিকে অবহিত করতে হবে।
আর্থিক অনিয়ম সম্পর্কে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে পিএ কমিটিতে পাঠানো জবাবেও ভুয়া ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে এ অর্থ উদ্ধারে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে বলে এতে সুপারিশ করা হয়।
পিএ কমিটির সভাপতি ডা. রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশ দিয়েছি। একটি সময় বেঁধে দিয়েছিলাম, বিষয়টি নিষ্পত্তি করে আমাদের জানানোর জন্য। তারা এখনো জানায়নি। আশা করি পরবর্তী বৈঠকেই তা জানাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন