পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে মানুষের কাটা মাথা লাগবে বলে সারাদেশে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। গুজবকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ‘ছেলে ধরা’ সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। এরইমধ্যে গুজব প্রতিরোধে মাঠে নেমেছে পুলিশ। গুজব প্রতিরোধ ও রটনাকারীদের গ্রেফতার করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কাজ করছেন পুলিশের সাইবার গোয়েন্দারা। (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)
ছেলে ধরা সন্দেহে ঢাকার মোহাম্মদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী। মোহাম্মাদপুরে এক নারীকে একই সন্দেহে বেদম মারধর করা হয়। পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। এছাড়া, লক্ষ্মীপুর জেলার দালাল বাজারে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে পুলিশে দেয় জনতা। ঘটনার আগে ওই ব্যক্তি রায়পুর-লক্ষ্মীপুর সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ছেলে ধরা সন্দেহে মারধরের এরকম আরও খবর পাওয়া যাচ্ছে।
২০১৫ সালের ১ মার্চ নদীতে পশুর রক্ত ঢেলে পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপন কাজের উদ্বোধন করে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় মূল সেতুর পরীক্ষামূলক ভিত্তি স্থাপনের সময় নদীতে গরু ও খাসির রক্ত ঢালতে দেখা যায় চাইনিজ ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের। ভাসিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি মুরগিও।
তাদের বিশ্বাস, বড় কাজের শুরুতে পশু উৎসর্গের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, এড়ানো যায় বড় দুর্ঘটনা। তখন গণমাধ্যমেও এনিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময়ের রক্তের ছবি এখন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে একটি মহল। অসাধু ফেসবুক ব্যবহারকারীরা মূল তথ্য আড়াল করে পুরনো সেই ছবিকে মানুষের রক্তের ছবি বলে চালাতে থাকে।
পুলিশের সূত্র বলছে, ২০১৬- ২০১৭ সালে এই চক্রটি চুপচাপ ছিল। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম এই গুজবের সূত্রপাত হয় । এরপর গত কয়েক মাস চুপচাপ থাকার এবছরের মার্চ মাস থেকে ফের শুরু হয় গুজব। বলা হয়, পদ্মা সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগবে। একটি চক্র এ ধরনের মনগড়া বক্তব্য দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর এই ব্যক্তিদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছে।
গুজব প্রতিরোধে সচেতন নাগরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পাল্টা সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর সুপারিশ করেছেন মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান। পাশাপাশি গুজবকারীদের বিষয়ে কঠোর হয়ে দেশের প্রচলিত আইনে বিচারের আওতায় আনতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের গুজব মানুষ হত্যার হাতিয়ার। গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে। এর আগে আমরা ধর্মসহ বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যা করতে দেখেছি। কিন্তু এ ধরনের গুজব এই প্রথম। গুজবকারীদের যেভাবেই হোক ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। তার আগে তাদের সতর্ক করতে হবে। আমাদের ডিজিটাল আইনেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’
পুলিশ সদর দফতর এ নিয়ে নাগরিকদের উদ্দেশে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গুজবে বিভ্রান্ত হবেন না। পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে, এটা গুজব।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা এধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার এআইজি সোহেল রানা বলেন, ‘কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে বলে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে। এটি পুরোপুরি মিথ্যা ও গুজব। এসব গুজবে কান না দেয়ার জন্য দেশবাসীকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এবিষয়ে গত ৯ জুলাই বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষও একটি নোটিশ জারি করেছে।’
পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, পদ্মা সেতু দেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি জড়িত। একটি মহল এই উন্নয়ন ব্যাহত করতে এ ধরনের গুজব রটিয়ে দেশবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, যা গুরুতর অপরাধ। অনেকে না বুঝেই এটি শেয়ার করে অপরাধের অংশীদার হচ্ছেন।
পুরো বিষয়টি নজরদারিতে রয়েছে উল্লেখ করে পুলিশের তরফে বলা হয়েছে— লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কিছু মানুষ এ গুজবের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে, যাদের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে, তাদের নাম ও ছবি ব্যবহার করে, গুজব ছড়ানোর জন্য তাদেরকে দায়ী করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। যারা এবিষয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর গুজব ছড়াচ্ছেন, তাদের খুঁজে বের করতে এবং আইনের আওতায় আনতে পুলিশের বেশ কয়েকটি বিশেষ সাইবার গোয়েন্দা দল অনুসন্ধান তৎপরতা শুরু করেছে বলে জানান এআইজি সোহেল রানা।
তিনি বলেন, ‘দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির লক্ষ্যে এমন গুজব ছড়ানো একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই এ ধরনের গুজব না ছড়াতে এবং তাতে কান না দেওয়ার জন্য দেশবাসীকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন