ভয়ঙ্কর এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ইয়াবা মামুন। ষষ্ঠ শ্রেণি পাশ করে মাইক্রো ড্রাইভার থেকে বিএনপির রাজনীতিতে হাতেখড়ি। বর্তমানে তিনি স্বঘোষিত যুবলীগ নেতা হিসেবে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার সাম্রাজ্য গড়াসহ চাঁদাবাজি, জমি দখল করে বিপুল অর্থ বিত্তের অধিকারী। তার মাদক সাম্রাজ্য রক্ষায় ৪০/৫০ জনের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে টু-শব্দ করারও উপায় নেই। এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও প্রতি মুহূর্তে তাকে নিয়ে আতঙ্কে দিন পার করেছে। ইতোমধ্যেই মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলায় বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর আহত করাসহ অসংখ্য বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় মামুন বাহিনীর মারপিটের শিকার চার ব্যক্তি বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এলাকার অনুসন্ধানে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন ইয়াবা মামুন। পাবনা পৌর এলাকার নূরপুর বাইপাস সড়কে রয়েছে তার বিলাসবহুল দুই তলা বাড়ি। তার গাড়ি বহরে রয়েছে একটি বিলাসবহুল কার, প্রাডো জিপ, একটি কারসহ ২০/২৫ টি মোটরসাইকেল। তার চালচলনে তিনি বিশাল নেতা, তাই যেন বোঝাতে চান। বাড়ি থেকে মামুন বেরোলেই আগপিছু মোটরসাইকেল, বহরের মাঝখানে বিলাসবহুল গাড়িতে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে। তার সাথে সার্বক্ষণিক ১০ জন দেহরক্ষী দায়িত্ব পালন করে। এসব নিরাপত্তারক্ষীদের আড়াই লাখ টাকা মাসিক বেতন গুনতে হয় ইয়াবা মামুনকে।
পারিবারিক অনুসন্ধানে জানা যায়, তার পিতার নাম হুমায়ূন ড্রাইভার, মাতা- খোদেজা বেওয়া। খোদেজার তৃতীয় স্বামীর ঘরে জন্ম নেয় ইয়াবা মামুন। খোদেজার প্রথম স্বামী নাসিম মোল্লা নুরপুরের শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। কুখ্যাত এ রাজাকারকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে।
মামুন পাবনা আরএম একাডেমি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে মাইক্রো ড্রাইভার হিসেবে সৌদিতে পাড়ি জমায়। বিএনপি আমলে দেশে ফিরে এসে নিজ ভাই খলিলের হাত ধরে বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর নূরপুরের প্রভাবশালী পরিবারের এক সন্তানকে প্রকাশ্যে মারপিট করে মামুন প্রথমে প্রচারে আসে।
আওয়ামী লীগ আমলে সে স্বঘোষিত সদর থানা যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা বনে যান। তার বিরুদ্ধে রড বোঝাই ট্রাক ডাকাতি, শালগাড়িয়ায় প্রভাবশালী ২টি বাড়িতে বড় ধরনের ডাকাতি, ব্র্যাক অফিসে ১৮ লাখ টাকা ডাকাতির ঘটনায় নাম আসলেও থানায় কোনও মামলা হয়নি। তার দুলাভাই ডিবি পুলিশের প্রভাবশালী এসআই (বর্তমানে অবসর) হান্নান সরকারকে ব্যবহার করে তিনি একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন।
দুলাভাইয়ের ক্ষমতার জোরে ইয়াবা মামুন ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার সাম্রাজ্য বনে যান। তিনি পাবনাসহ কুষ্টিয়া, নাটোর, সিরাজগঞ্জ জেলায় মাদক ব্যবসার জাল বিস্তার করে। এ চার জেলার মাদক ব্যবসার পাইকারী মহাজন হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে অসংখ্য মাদক কারবারীরা তার কাছে এসে ভিড় জমায়। শুধু তাই নয় তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরিরও অভিযোগ ওঠে। মিয়ানমার থেকে প্রায়ই তার বাড়িতে লোকজন আসার খবরও এলাকার সবাই জানেন। বাইপাস মোড়ে এক শিল্পপতির গোডাউনে ইয়াবা কারখানা গড়ে তোলে ইয়াবা মামুন। এ ঘটনা জানাজানি হলে কারখানাটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। মামুন পাবনার ওই মহিলা শিল্পপতির ডান হাত বনে যান। ওই শিল্পপতি তাকে দিয়ে অনেক অনৈতিক কাজ করেছেন বলে পাবনায় জনশ্রূতি রয়েছে। ইয়াবা মামুন তার মাদক ব্যবসা ঠিক রাখতে ৪০/৫০ জনের সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করা হয়।
আওয়ামী লীগের ত্যাগি নেতাকর্মীদের কাছে মামুন মানেই এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। অসংখ্য আওয়ামী লীগ নেতা তার হামলার শিকার হয়েছে। নূরপুরের বাসিন্দা জেলা কৃষক লীগের প্রচার সম্পাদক আঙ্গুর মামুনের মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করলে তার শরীরের ১৪টি জায়গায় কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার একটি হাত এখনও অসাড় রয়েছে।
নূরপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ইবরা, রাজ্জাক মেম্বার, অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান, আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক কমিশনার ইকরাম আলী, থানা আওয়ামী লীগ নেতা পাঞ্জাব মামুন বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছে। মালিগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি হামদু বিশ্বাসের বাড়িঘর ভাঙচুর শেষে পুড়িয়ে দেয় মামুন বাহিনী।
মালিগাছা ইউনিয়নের রামানন্দপুর আওয়ামী লীগ নেতা সবুজ, আওয়ামী লীগ নেতা পাঞ্জাব, ইজাই, হানিফ আলী, খোকনসহ ২৫টি বাড়িতে একদিনে আক্রমণ চালিয়ে মামুন বাহিনী বাড়িঘর লুটপাটসহ আগুন ধরিয়ে দেয়। তার আক্রমণে শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই।
মামুন বাহিনীর হামলায় শহরের রূপকথা রোডের একটি চায়নিজ রেঁস্তরা (স্বাগতম) ভাংচুর করা হয়। অচিন্ত্য ঘোষের বাড়িতে হামলা এবং কসাই পট্টির শিশুদের স্কুলে হামলা করে শিক্ষককে মারপিট করে মামুন বাহিনী।
রামানন্দপুর গ্রামের আকুল, আলম ও নূরু মোল্লার জায়গা দখল করে ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে মামুন। একই গ্রামের ফ্যোনে মোল্লার ৩ বিঘা জমি দখল করে নেয় মামুন। মামুন বাহিনী বিলভাদুরিয়া গ্রামের ওসমান, বক্কার ও ইসমাইলকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। বিদেশ ফেরত ইসমাইলের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে মামুন। এ ঘটনায় সে অস্বীকৃতি জানালে তাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ভুগে ভুগে তিনি মারা যান।
ইয়াবা মামুনের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার সংবাদ পরিবেশন করায় দৈনিক সংবাদ এর স্টাফ রিপোর্টার হাবিবুর রহমান স্বপনকে হেলমেট বাহিনী দিয়ে রড দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এই মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতারে পুলিশ প্রশাসনকে সাংবাদিক সমাজ কয়েকদিন ধরে আল্টিমেটাম দিলেও পুলিশ নিরব রয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে একজন জনপ্রতিনিধি ব্রেকিংনিউজকে বলেন, এমন কোনও অপকর্ম নেই যে মামুন করে না। প্রতি নিয়ত মামুন বাহিনীর ক্যাডার দিনে দুপুরে নিরীহ মানুষকে আঘাত করছে, চাঁদা নিচ্ছে, মাদক ব্যবসা করছে। মামুনের ব্যাপারে এলাকার সাধারণ মানুষ মুখ খুলে কিছু বলতে পারে না ভয়ে। মামুন বাহিনীর আতঙ্কে কেউ থানায় মামলাও করতে যায় না।
এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহ আল মামুন ব্রেকিংনিউজকে বলেন, আমার কিছু বন্ধু ছিল, একসময়ে তাদের সাথে ঝামেলা হয়। ঝামেলা হওয়ার পর থেকেই ফেসবুকে বিভিন্নভাবে তারা আমার নামে খারাপ কথা ছড়িয়েছে। এ জন্য থানাতে আমি একটি জিডিও করেছি। পাবনার মানুষ সবাই জানে আমি কেমন। আমি যদি এতই খারাপ হয় তাহলে এই সরকারের আমলে আমার বাঁচার সম্ভবনা ছিল না এতদিন। পাবনাতে যদি কেউ মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তাহলে আমার থেকে কেউ বেশি অভিযান চালায়নি। আমার এলাকার আশেপাশেও যদি শুনি মাদকের ব্যবসা হচ্ছে তাহলে আমি নিজে তাদেরকে ধরে প্রসাশনের হাতে তুলে দিই।
তিনি বলেন, কেউ প্রমাণ করতে পারবে না আমি পাবনার কারো কাছ থেকে এক টাকা চাঁদা নিয়েছি। আমি কাউকে মারধর করিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের মারধরের যে নামগুলো এসেছে তাদের দু'একজনকে ছাড়া আমি কাউকেই চিনি না।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবায়দুল হক ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘আমার জানামতে মামুনের নামে থানায় কোনও মামলা নেই। তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগও দেয়নি।’
চলবে...
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন