‘যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা যৌক্তিকভাবে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল বলে দাবি করেন। আর সেই দলের পক্ষ থেকেই যদি ঐতিহাসিক ভবন ভেঙে হাসপাতাল বানানোর মত অবিবেচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে তা মেনে নেওয়া যায় না’ - এমন কথাই বলেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি সুলতানা কামাল।
শুক্রবার (১৭ মে) বিকেলে সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সোলেমান হলে ‘সিলেটের বিপন্ন স্থাপত্য ঐতিহ্য ও আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন: নাগরিক উদ্বেগ’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমরা কেউই হাসপাতাল তৈরির বিপক্ষে নই। আমরা হাসপাতাল বা সরকার কারো বিরোধীতা করতে আসিনি। আমরা চাই ঐতিহ্য রক্ষা করে উপযুক্ত স্থানে হাসপাতাল নির্মাণ করা হোক। ছাত্রাবাস ভবন রক্ষার লড়াইটি নিজেদের অস্তিত্ব টেকানোর লড়াই।
ভবন ভাঙার বিষয়টি উল্লেখ করে সুলতানা কামাল বলেন, ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রবাস ভবন রক্ষার্থে দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করছে সিলেটের নাগরিক সমাজ। আমরা মনে করি সরকারের উচিত জনগণের কথা শোনা। জনগণের নির্বাচিত সরকার যখন জনগণের কথা শুনতে ভয় পায়, তখন বুঝতে হবে সরকার ও জনগণের সম্পর্কের অবস্থার অবনতি হয়েছে।
বাপার কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক শরীফ জামিলের পরিচালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন- জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে আব্দুল মুবিন, বাংলাদেশ হেরিটেজ সোসাইটির সভাপতি সোহেল আহমদ চৌধুরী, বাংলাদেশ স্থপতি ইনিস্টিটিউট সিলেট শাখার সভাপতি স্থপতি সৈয়দা জেরিনা হোসেন, জাসদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাকির আহমদ, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আরশ আলী, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সিএম তোফায়েল সামি ও সিলেট মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী প্রমুখ।
স্থপতি সৈয়দা জেরিনা হোসেন বলেন, পরিকল্পনাবিহীন কোনো উন্নয়নই উন্নয়ন নয়। এই জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এই ভবনের আশপাশের পরিবেশ ও জনসমাগম হাসপাতাল নির্মাণের প্রধান বাঁধা। ঐতিহ্য নিয়ে সারা দুনিয়ায় ব্যবসা হচ্ছে। আমরাও পারি সিলেটের ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়িক পরিবেশগত উন্নয়ন সাধন করতে। এই জায়গাটাকে নাগরিক পরিসরে রূপ দিতে। যেখানে সিলেটের মানুষজন ও আগত পর্যটকরা সময় কাটাবেন।
হেরিটেজ সোসাইটির সভাপতি সোহেল আহমদ চৌধুরী বলেন, সারা বাংলাদেশের মতো সিলেটের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো বিভিন্ন কারণে বিলীন হয়ে গেছে। এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ না করলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম গালি দেবে। কারণ এতিহ্য শুধু দেখার বিষয় নয়, শিক্ষারও অংশ। তাই এই ঐতিহ্যের সংরক্ষণে বাপার ছয় দফা দাবিকে সমর্থন করি।
জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে আব্দুল মুবিন বলেন, আবু সিনা ছাত্রবাস একটি ঐতিহাসিক ভবন। এই ধরনের স্থাপনা নিয়ে গর্ব করা যায়। এটাই আমাদের ইতিহাস। হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে বা স্বাস্থ্যসেবারও বিরুদ্ধে নই। এই সরকার জনগণের সরকার। এই সরকারও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নয়, স্বাস্থ্যসেবারও বিরুদ্ধে নয়। আমাদের সিলেটে পাঁচজন মন্ত্রী আছেন। তারা চাইলে ঐতিহ্য রক্ষা করে হাসপাতাল নির্মাণ করতে পারেন। এটা আন্দোলন নয়, এটা আমাদের প্রাণের দাবি, যৌক্তিক দাবি। আমাদের ঐতিহ্যেই আমাদের পরিচিতি।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম ক্বিম ও ধারণাপত্র পাঠ করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কৌশিক সাহা।
সেমিনারে বাপার পক্ষ থেকে ছয় দফা দাবির কথা জানানো হয়। দাবিগুলো হলো- ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাস ভবন ভাঙার কাজ বন্ধ করে ভবনটি সংস্কার ও সংরক্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, ঐতিহ্য সমীক্ষার মাধ্যমে সিলেটের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক নিদর্শনগুলোর তালিকা তৈরি করে ডকুমেন্টেশন তৈরির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্যসমূহ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তালিকাভুক্তি করার ব্যবস্থা নিতে হবে, সিলেটে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের বিভাগীয় অফিস স্থাপন করে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ব ও স্থাপত্য ঐতিহ্যসমূহ পর্যায়ক্রমে সংরক্ষণের আওতায় আনতে হবে, সিলেট নগরের ঐতিহ্য সংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে পরবর্তী সময়ে মহাপরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে, সিটি করপোরেশনের ঐতিহ্য সেল গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও দেখাশুনার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও তদারকির জন্য বিভিন্ন পেশাজীবী, গবেষক, সংস্কৃতিকর্মী, পরিবেশকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ে নাগরিক কমিটি গঠন করতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন