নিহত নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের আবেদনের কপি। ছবি: ইত্তেফাক।
আগামীকাল ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ৫ বছর। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহরণের পর খুন হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭জন।
নজরুল নিহত হওয়ার ৪৭ দিন আগেই আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন তাকে মেরে ফেলবে আশংকা করে নজরুল ইসলাম জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে যাদের কাছে আবেদন করেছিল তাদের হাতেই প্রাণ গিয়েছে তার!
২০১৪ সালের ৯ মার্চ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বরাবর জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ১দিন পর ১০ মার্চ আবেদনটি পাঠানো হয় র্যাব ডিজির বরাবর। র্যাবের ডিজি র্যাব-১১ এর সিইও এর কাছে ১১ মার্চ পাঠায়। সেই র্যাব-১১ এর সিইও তারেক সাঈদের নেতৃত্বেই নজরুলসহ আরও ৬ জনকে খুন হয়।
শুক্রবার দুপুরে নজরুলের বাসায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামের সঙ্গে কথা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে করা আবেদনটি দেখিয়ে এমন মন্তব্য করে কাঁদছিলেন তিনি। দীর্ঘ ৫ বছর যাবৎ নজরুলের করা আবেদন ও অন্য স্মৃতি আঁকড়ে ধরে দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে করা আবেদনে উল্লেখ করেন, ‘১৯৯৮ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদ নিয়ে তৎকালীন বিএনপির নেতা ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া নূর হোসেনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এরপর সে আমাকে হত্যা করতে নানাভাবে চেষ্টা চালায়। এর কিছুদিন পর নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হলে নূর হোসেনের লোকজন মিজমিজি এলাকার নিরীহ জহিরকে গুলি করে হত্যা করে। ২০০০ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কার্যালয়ের সামনে আমাকে হত্যার জন্য ভাড়াটিয়া খুনী দিয়ে গুলি করলে আমার বাল্য বন্ধু যুবলীগের থানা কমিটির সদস্য আব্দুল মতিন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এ সময় এলাকায় নূর নানা অপকর্ম করে সন্ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ালী লীগ ক্ষমতায় এলে নূর হোসেন দেশে ফিরে এসে পুনরায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি, নদী দখল, মাদক ব্যবসা পাশাপাশি শিমরাইল চৌরাস্তা ট্রাক স্ট্যান্ডে রাতের অন্ধকারে অশ্লীল নৃত্য ও জুয়ার আসর বসায়।
সর্বশেষ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে ২ নং ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়ার মৌচাক সড়কে সিটি কর্পোরশনের রাস্তা নির্মাণ কাজ তদারকি করার সময় ২০-২৫টি মাইক্রোবাস নিয়ে নূর হোসেন ও তার ২ শতাধিক সন্ত্রাসী সহকর্মী সশস্ত্র অবস্থায় আমাকে হত্যা করার জন্য জনসম্মুখে ১৫ থেকে ২০ রাউন্ড গুলি করলে মানুষ পালাতে থাকে। তখন সন্ত্রাসী দল এলোপাতাড়ি পিটিয়ে চৌধুরীপাড়া জামে মসজিদের মোয়াজ্জিমসহ ৫ জনের হাত ভেঙ্গে দেয়। ১০-১৫টি দোকান ভাংচুর করে চলে যায়। নূর হোসেনের উপস্থিতিতে এ তাণ্ডব চলে প্রায় ১ ঘন্টা। আমি এসআই মোঃ শওকত এর উপস্থিতিতে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে উল্টো দোকান ভাংচুরের ঘটনার আমাকেসহ ১৭ জনের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। এরপর থেকে প্রকাশ্যে অস্ত্রসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী মিজমিজি এলাকায় ঘুরাফেরা করছে আমাকে হত্যা করার জন্য। যে কারণে সেই ১৯৯৮ সালের মত চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছি। যে কোন সময় মৃত্যুর মুখে পড়ে যেতে পারি।’
জীবনের নিরাপত্তার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাবরে আবেদন করেও শেষ রক্ষা হয়নি। আবেদনের দেড় মাসের মাথায় আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতেই খুন হতে হয় নজরুলসহ নিরপরাধ আরও ৬ জন।
৭ খুনের আদ্যোপান্ত ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহরণ করা হয় নজরুল, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমকে। ৩ দিন পর ৩০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া শান্তি নগর এলাকা থেকে তাদের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন একই জায়গা থেকে উদ্ধার হয় নজরুলের আরেক বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ। সব লাশের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
নজরুলের শ্বশুর অভিযোগ করেন, ‘র্যাবের তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা ও মেজর আরিফ হোসেন ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে এ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করে। এরপর ২০১৪ সালের ১১ মে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, সদস্য মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পালের রিট আবেদনে হাই কোর্ট তিন র্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। নির্দেশের পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১৫ মে পুলিশকে চিঠি দিয়ে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর (সিআরপিসি) অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলে। ওইদিন রাতেই মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় ঢাকা সেনানিবাসের বাসভবন থেকে তারেক সাঈদ ও মেজর আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। পরদিন রাতে নৌ-বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা মাসুদ রানাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে তুলে দেয়।
আইন শৃংখলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে পুরো ঘটনা। এ ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন। ঘটনার পর নূর হোসেন পালিয়ে ভারত গেলে ওই বছরের ১৪ জুন কলকাতার দমদম বিমানবন্দর সংলগ্ন বাগুইআটি থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৪ নভেম্বর তাকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠায়।
এদিকে এ হত্যা মামলাটি তদন্ত করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৫ জনকে আসামি করে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠন করে আদালত।
গত ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন আদালতে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদন্ড দেয়। দুই মামলায় ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি নয়জনকে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে হাইকোর্ট নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ে কাউন্সিলর নুর হোসেন এবং সাবেক র্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন। বাকি ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এছাড়া ৯জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের রায় হাইকোর্টেও বহাল রয়েছে।
গত ১৯ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় আনা দুই মামলায় ১ হাজার ৫৬৪ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশ করা হয়। রায় প্রদানকারী বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম রায়ে স্বাক্ষর করেন।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর চলতি বছরের ৩ মার্চ মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস চেয়ে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন দণ্ডপ্রাপ্তরা।
ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন