ঢাকা ওয়াসার পানি ‘শতভাগ বিশুদ্ধ’ বলে দাবি করলেও সেই পানি দিয়ে তৈরি করা শবরত খাওয়াতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানকে অফিসে পাননি রাজধানীর জুরাইন এলাকার বাসিন্দারা।
আজ মঙ্গলবার বিকেলে এ বিষয়ে দৈনিক আমাদের সময় অনলাইন’র সঙ্গে কথা বলেন ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে এমডিকে ওয়াসার ‘সুপেয় পানি’ দিয়ে বানানো শরবত খাওয়াতে কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনের সামনে হাজির হন জুরাইন এলাকার বাসিন্দারা। এ সময় তাদের সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার পানি, চিনির প্যাকেট ও লেবু ছিল।
আজ অফিসে না থাকা প্রসঙ্গে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘আমাদের ডাইরেক্টর (পরিচালক) সাহেবের সঙ্গে তাদের (শরবত নিয়ে আসা ব্যক্তিদের) কথা হয়েছে। আমি এখন পিএম অফিসে আছি। আজকে সকালে একটা প্রোগ্রাম ছিল আমার। তারপর শ্রীলঙ্কায় নিহত সেলিম ভাইয়ের নাতির ওখানে গিয়েছিলাম, শোক জানাতে। তারপর পিএম অফিসে এখন মিটিংয়ে আছি।’
এমডি আরও বলেন, ‘আমার ডাইরেক্টর সাহেব অভিযোগকারীদের কথা শুনেছেন। উনি জবাব দিয়েছেন। উনারা গিয়েছিলেন যে, উনাদের ওখানে পানি অপরিষ্কার। সেই কমপ্লেইনটা উনারা রেখেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করতে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
জুরাইন এলাকার পানি সংগ্রহ করা হবে জানিয়ে ওয়াসার এমডি বলেন, ‘পানি নেবে সোর্স থেকে। পানিটা নেওয়ার জন্য লোক ঘটনাস্থলে গেছে। ধরেন একটা জায়গার পানি খারাপ, তো সেই পানি তিন জায়গা থেকে নিতে হয়। আমাদের সোর্স, বাসায় ঢোকার পথে আর ট্যাব। তিনটা টেস্ট করা হয় সব পানির জন্য। তো ওই টেস্ট করার জন্য ল্যাবের লোকদের পাঠিয়ে দিয়েছে। ওই এলাকা থেকে পানি নিয়ে তারপর ল্যাবে দেওয়া হবে।’
পরবর্তীতে ওয়াসার পানি দিয়ে তৈরি করা শরবত অফিসে নিয়ে গেলে খাবেন কি না, এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, ‘কারও পানিতে যদি প্রবলেম থাকে, সেটা আমরা টেস্ট করব, টেস্ট করে সল্যুশন দেব। যদি খারাপ হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে, সেই কারণটা দূরীভূত করব।’
তাকসিম এ খান আরও বলেন, ‘তো যারা কমপ্লেইন নিয়ে এসছিলেন, তাদের কমপ্লেইনগুলো দেখা হয়েছে, ডাইরেক্টর সাহেব কথা বলেছেন এবং তাদের কমপ্লেইনগুলো রেখে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে যেভাবে আমরা স্যাম্পল কালেক্ট (নমুনা সংগ্রহ) করি, উনি যে অ্যাডড্রেস দিয়েছেন, যেখানকার পানিটা, সেখানে গিয়ে তারা পানিগুলো সংগ্রহ করে ল্যাবে দেবেন। ল্যাবের টেস্ট আসলে উনাদের প্রতিবেদন পৌঁছে দেওয়া হবে। যদি রেজাল্ট (ফল) ভালো হয় তাহলে ভালো, আর যদি ভালো না হয় তাহলে কেন, সেটা তারা বের করবেন।’
পানির সমস্যা কি কারণে হতে পারে, তা জানাতে গিয়ে ওয়াসার এমডি বলেন, ‘যেমন ধরেন পাইপলাইন লিক হতে পারে, অথবা বাসার ট্যাংকটা অপরিষ্কার থাকতে পারে, অথবা সেখানে... জন্মাতে পারে। সেই জন্য তারা নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন।’
আজকের শরবত খাওয়ানোর এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দেন রাজধানীর জুরাইন এলাকার বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমান। দুপুরের দিকে তাদের সঙ্গে কথা বলেন ওয়াসার প্রকৌশলী ও কে এম সহিদ উদ্দিন। এ সময় তিনি বলেন, ‘পাইপ লাইনের ত্রুটির কারণে ওয়াসার পানি দূষিত হয়ে থাকতে পারে, তবে ওয়াসার পানি সুপেয়।‘
২০১৩ সালে একবার এমন সমস্যা হয়েছিল। তখন এমডি সেটার সমাধান করে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এখন এমডি যে বলছেন, প্রত্যেকটা বাড়িতে সুপেয় পানি পাওয়া যায় তা সঠিক নয়। এর উত্তরে ওয়াসার প্রকৌশলী বলেন, ‘আপনাদের যার যার প্রশ্নের উত্তর আপনাদের নিজেদের কাছেই আছে।’
যারা কমপ্লেইন করেছে তাদেরটা ঠিক করবেন নাকি পুরো ঢাকায় ঠিক করবেন, এর জবাবে সহিদ উদ্দিন বলেন, ‘পুরো ঢাকা না, যারা যারা কমপ্লেইন নিয়ে আসবেন সেখানে গিয়ে আমরা সমস্যার সমাধান করব। তাহলে আশেপাশের সব মানুষ ভালো পানি পাবে।’
প্রকৌশলী বলেন, ‘আমাদের ঢাকা শহরে ১০টি জোন আছে। প্রত্যেকটা জোনে লক্ষ্য বলা আছে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে জোনে গিয়ে কমপ্লেইন দিলে আমরা সেটা ঠিক করে দিয়ে আসব।’
এ সময় পানির কোনো সমস্যা হলে ১৬১৬২ নম্বরে কল দিলে তিনদিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান করা হয় বলেও জানান প্রকৌশলী সহিদ উদ্দিন।
এর আগে টিআইবি থেকে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান। গত শনিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, ‘ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়। টিআইবি যে পদ্ধতিতে এ গবেষণা করেছে সেটি একপেশে ও উদ্দেশ্যমূলক। এটি পেশাদারি গবেষণা হয়নি। ৩৩২ কোটি টাকার অপচয়ের বিষয়ে টিআইবির গবেষণা অনুমান নির্ভর ও বাস্তবতা বিবর্জিত। ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি উৎস থেকে গ্রাহকের জলাধার পর্যন্ত পানি সম্পূর্ণ শতভাগ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ।’
তাকসিম এ খান বলেন, ‘সবাই এ পানি ফুটিয়ে খায় তাহলে জারের পানি ও বোতলজাত পানি কোথায় যায়? টিআইবির গবেষণায় অপচয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বছরে ৪০০ কোটি টাকা এবং সিস্টেম লস কমানোর মাধ্যমে আরও ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করছে ওয়াসা। বিষয়টি টিআইবির গবেষণায় উল্লেখ করা হয়নি।’
এর আগে গত বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত মাইডাস সেন্টারে ‘ঢাকা ওয়াসা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করে দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করে। গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতিবছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়।’
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, গবেষণাটির জন্য টিআইবি মাঠপর্যায়ে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ওয়াসার ১০টি মডস জোনের মোট ২ হাজার ৭৬৮ জন গ্রাহকের মতামত নেয়। জরিপের ফলাফলে বলা হয়, এই গ্রাহকদের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশই ওয়াসার সেবায় অসন্তুষ্ট। এর মধ্যে ২০ দশমিক ১ শতাংশ সন্তুষ্ট। আর ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ গ্রাহক ওয়াসার সেবায় মোটামুটি সন্তুষ্ট।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন