সাজানো-গোছানো বাড়ি। ইটের পাকা ঘর। জায়গা নিচু হওয়ায় বাড়িটি তৈরি করা হয়েছে একটু বিশেষ কায়দায়। কংক্রিটের মজবুত ভিতের উপর তৈরি বাড়িটি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি নদীর মাঝখানে। দখল-বেদখলে নদীটির দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এক সময়ের খরস্রোতা নদী আজ তৃষ্ণার্ত! বুক চিরে চাষ হওয়া ধানক্ষেতের নালাগুলো দিয়ে যেনো তার চোখের জল ঝরছে।
কষ্টের উপাখ্যানগুলো কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার সোনাভরি নদীর। মানচিত্রে থাকলেও বেদখলের মহোৎসবে বাস্তবে নদীটিকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। আর তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ কর্মসূচি বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান-২১০০-এর প্রথম প্রকল্পের আওতায় নদীর সাড়ে ৯ কিলোমিটার পূণঃখনন কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
এমনকি বেদখলকারীদের বাঁধায় মাঠ জরিপ করে ভরাট হওয়া নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে পারেননি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ কারণে পুনঃখননের কার্যাদেশ দেয়ার প্রায় ৩ মাস পার হতে চললেও সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। আর দখলমুক্ত করার কাজ চলেছে ঢিমেতালে। অথচ পূণঃখনন কাজের সময়সীমা বেধে দেয়া আছে আগামী ১৫ জুন পর্যন্ত।
ফলে কর্মসূচির উদ্দেশ্য অর্জন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বরাদ্দের সোয়া ৪ কোটি টাকারও বেশি ফেরত যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, সোনাভরি নদী রাজিবপুর উপজেলার মেম্বারপাড়া এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে ৩০ কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর রৌমারী উপজেলার হামিদপুর এলাকায় হলহলিয়া নদীর সাথে মিশে গেছে। নদীটির বিভিন্ন স্থানে ভরাট হওয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। তবে বর্ষাকালে পানির স্রোতধারা প্রবাহিত হয়। এ অবস্থায় ভরাট হওয়া এলাকাগুলো প্রভাবশালীরা বেদখল করে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ করে। এমনকি অনেকে মাটি ভরাট করে চারদিকে সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন।
এই পরিস্থিতিতে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা ও সেচ সুবিধাসহ পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে ডেল্টা প্লান-২১০০ এর আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের ৬৪ জেলার অভ্যন্তরীণ ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় পূণঃখনন প্রকল্পের মাধ্যমে সোনাভরি নদী পূণঃখনন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে উৎপত্তিস্থল মেম্বারপাড়া থেকে মরিচাকান্দি পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য রংপুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাজ মঞ্জিল এবং প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে খঞ্জনমারা থেকে হামিদপুর পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার পুণঃখননের জন্য কুড়িগ্রামের বেলাল কনস্ট্রাকশনকে ঠিকাদার নিযুক্ত করে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি কার্যাদেশ দেয়া হয়। তবে এখনও পর্যন্ত কাজ শুরু হয়নি।
সূত্র আরো জানান, পূণঃখনন কাজ শুরু করার জন্য গত ৩১ জানুয়ারি মাঠ জরিপের মাধ্যমে নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গেলে ইমান আলী, জাকির হোসেন মেম্বার, লালচাঁন মিয়া ও আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে দখলদাররা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের বাঁধা দেন এবং পরিমাপের টেপ ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর গত ২৭ মার্চ নদীর স্থিরচিত্র তুলতে গেল তাতেও বাঁধা দেন তারা। এ সময় ওই ব্যক্তিরা দাবি করেন জমিগুলোর আরএস এবং দিয়ারা রেকর্ড তাদের নামে আছে। অথচ সিএস রেকর্ডে সোনাভরি নদী সম্পূর্ণ সরকারি খাস বলে উল্লেখ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইমান আলী স্থানীয় আরএসডিএ নামক এনজিও’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং রৌমারী উপজেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি। তার সঙ্গে এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি দাবি করেন, মাঠ জরিপে কাউকে বাঁধা দেননি। সোনাভরি নদী ভাঙতে ভাঙতে তাদের জমিতে চলে এসেছে। তিনি তার নিজের জমিতে বাড়ি করেছেন বলেও দাবি করেন।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর রায় জানান, ইমান আলীসহ কিছু ব্যক্তি স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাতে তারা উল্লেখ করেছেন, স্থানীয় কিছু ব্যক্তি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং তাদের নামীয় কিছু জমি সেখানে আছে বিধায় খননের প্রয়োজন নেই।
তবে সবকিছু খতিয়ে দেখে দ্রুত পূণঃখনন কাজ শুরু প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আরিফুল ইসলাম জানান, জরিপে বাঁধা দেয়ার ঘটনাসহ সার্বিক অবস্থা লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট সকলকে জানানো হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাকির হোসেনকে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। তিনি বিষয়টি সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এজন্য দ্রুত দখলমুক্ত করে খনন কাজ শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক ও জেলার অভ্যন্তরে ছোট নদী, খাল, জলাশয় পূণঃখনন কমিটির সভাপতি মোছাঃ সুলতানা পারভীন জানান, জেলা কমিটির সভা আহ্বান করতে বলা হয়েছে। সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন