ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। লিখছেন, গবেষণা করছেন অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি, উন্নয়ন, চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতি-গণতন্ত্রের সম্পর্কের বিষয়টিও। বাজেটকে অর্থ অপচয়ের বিশেষ আয়োজন বলে উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জায়গায় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু
জাগো নিউজ : আগের পর্বে ব্যাংকিং খাত, শেয়ারবাজারের সংকটের কথা বলছিলেন। এসব তো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দায়?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে। এটি একটি রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ চিত্র। শেয়ারবাজারে ধস হয়েই যাচ্ছে। ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক এটি তদারকি করার কথা। এ রকম জনসম্পৃক্ত প্রতিটি সেক্টর এখন মনিটরিংয়ের বাইরে। যে যার মতো কাজ করছে। কোনো সমন্বয় আছে বলে আর মনে হয় না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতা আছে, স্বকীয়তা আছে। অথচ কেউ তার জায়গা থেকে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারছে না।
জাগো নিউজ : শেয়ারবাজার নিয়ে ধসের কথা বলছিলেন। এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলবেন?
স্টক মার্কেট নিয়ে গবেষণা থাকলে মানুষ নিঃস্ব হত না
সালেহউদ্দিন আহমেদ : শেয়ারবাজার নিয়ে ’৯০-এর দশকে যে কেলেঙ্কারি ঘটেছিল সেখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার কথা ছিল। রাষ্ট্র, সরকার শিক্ষা নেয়নি। শিক্ষা নেয়া হয়নি বলেই ২০১০ সালের কেলেঙ্কারি। যে কেলেঙ্কারির ধারাবাহিকতা এখনও বিরাজমান।
কারা, কীভাবে এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তা সরকার এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠানের কাছে দৃশ্যমান। যারা শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারাও জানেন। অথচ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
জাগো নিউজ : ধসের এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শেয়ারবাজারের আসলে কী পরিণতি ঘটবে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশ ব্যাংকের জায়গায় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বড় বড় বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে শেয়ারবাজারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা মূলত তারাই রাখছে। দাম কখন বাড়বে, তা বড় প্রতিষ্ঠানগুলোই জানে। তখন তারা বিক্রি করে। আবার কখন কমবে, তাও তারাই জানে। তখন তারাই কিনে নেয়। আর সাধারণ মানুষ বোকার মতো তাদের খপ্পরে পড়ে যায়। সাধারণ মানুষকে এ ব্যাপারে ভালো ধারণা দেয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
উন্নয়ন আগে নাকি গণতন্ত্র আগে এই বিতর্ক সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করছে
স্টক মার্কেট নিয়ে গবেষণা নেই। মানুষ পাগলের মতো এসে বিনিয়োগ করছে। আর নিঃস্ব হয়ে ফিরে যাচ্ছে। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। সাধারণ মানুষকে তথ্য দেয়া হয় না। ব্যবসায়ীরা নীতিনির্ধারক হচ্ছে বলে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা হচ্ছে না। পোশাক কারখানার মালিকরা এখন সাংসদ। সংসদ ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি। এই সাংসদরা তো নিজেদের স্বার্থের বাইরে কোনো কাজ করবে না এবং এটাই স্বাভাবিক। সংসদ এখন ব্যবসায়ীদের দখলে, সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবেই।
জাগো নিউজ : ব্যবসায়ীদের এই আধিক্যের জন্য কোন বিষয়কে সামনে আনবেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : গণতন্ত্র সংকুচিত হলে পুঁজির অসম বিকাশ ঘটে। এখন তাই ঘটছে। আর এ কারণেই সরকারের নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীরা। কারণ পুঁজিই এখন ক্ষমতার উৎস। জনগণ নয়। এতে করে জনগণের স্বার্থ আর সেই অর্থে গুরুত্ব পায় না।
মানুষ দুই হাতে কাজ চায়, অথচ রাজনীতি সে হাত বেঁধে ফেলছে
জবাবদিহিতা নেই, সুশাসন নেই, গণতন্ত্র নেই। এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য কোনো স্বস্তির বার্তা দিতে পারে না। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার না থাকলে অথবা ভোটাধিকার যদি ক্ষমতায় বা অর্থের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে যায় তখন জনপ্রতিনিধি নামে মাত্র। তারা জনগণের না।
মানুষের কাছে জনপ্রতিনিধিদের কোনো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না বলে আমলারাও আর কোনো কাজে জবাবদিহি করতে অভ্যস্ত হচ্ছে না। ব্যাংকারদের জবাবদিহিতা নেই। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। দায়িত্বশীলদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। বড় বড় দুর্নীতি করে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তদন্ত নেই, বিচার নেই, শাস্তি নেই। এতে করে অন্য দুর্নীতিবাজরা আরও উৎসাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ঝুঁকি নিয়ে একজন তরুণ উদ্যোক্তা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বিনিয়োগ করতে।
সমাজে যথেষ্ট দক্ষ, উদ্যোগী মানুষ আছে। তাদের জায়গা দেয়ার পরিবর্তে বাধা দেয়া হচ্ছে। সরকারের পলিসিকেই আমি এর জন্য দায়ী করব। উন্নয়ন আগে নাকি গণতন্ত্র আগে এই বিতর্ক সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করছে। গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়নের কোনো মানে হয় না। আমি বলি গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন পাশাপাশি থাকতে হবে। এক পায়ে বেশি দূর এগুনো যায় না।
৯০-এর দশকে শিক্ষা নিলে ২০১০ এ শেয়ার কেলেঙ্কারি হত না
জাগো নিউজ : গণতন্ত্র সংকুচিত হলেও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা নিয়ে উচ্ছ্বসিত অনেকেই।
সালেহউদ্দিন আহমেদ : আমি আগেই বলেছি, স্বাধীনতার ৪৮ বছর কম সময় নয়। অন্যরা কী করেছে সেটা নিয়েও ভাবা দরকার। বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা তাতে সাধারণ মানুষের ভূমিকাই বেশি। ক্ষমতায় কে আসল তা নিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক, সাধারণ কৃষকের মাথাব্যথা নেই। তারা তাদের মতো করে কাজ করবেই। বরং অসুস্থ রাজনীতি এই মানুষগুলোকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই কাজ করে যাবে। নীতিগত প্রতিবন্ধকতা না থাকলে তারা আরও এগিয়ে যেত। মানুষ দুই হাতে কাজ চায়। রাজনীতি কাজ না দিয়ে সে হাত বেঁধে ফেলছে।
জাগো নিউজ : এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলবেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : আপনি সব রাস্তা বন্ধ করে শুধু উন্নয়নের কথা বললে আমি শুনতে রাজি নই। কারণ উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তাঘাটের উন্নয়ন বা বড় বড় প্রজেক্ট করাই নয়। একটি দেহে অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে। শুধু হাত-পা দৃশ্যমান দেখিয়ে আপনি বাঁচতে পারবেন না। আপনার অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ঠিক রাখতে হবে। রাজনীতি, গণতন্ত্র, সুশাসনের উন্নয়ন না ঘটিয়ে আপনি টেকসই কিছু করতে পারবেন না। বিশেষ করে চিন্তা তথা মানসিক উৎকর্ষ সাধনে আপনাকে গণতান্ত্রিক অধিকার দিতেই হবে। উন্নয়ন চিন্তায় মৌলিক বিষয়গুলো গুরুত্ব না পেলে এই এগিয়ে যাওয়া এক সময় থমকে যাবেই।
জাগো নিউজ : গণতন্ত্রের আড়ালে টেকসই উন্নয়নের গল্পও আছে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ : মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলা হয়। আমাদের এখানে এসব উদাহরণ হয়েছে। এই উদাহরণ এখন আর টিকবে না। কারণ বিশ্ব অন্যরূপে এগুচ্ছে। তাছাড়া সে দেশগুলোর যে শাসক ব্যবস্থা তা আমাদের এখানে নেই। সেখানে, সুশাসন আছে, জবাবদিহিতা আছে। আমাদের এখানে। সুবিধাবাদী উদাহরণ দিয়ে তো আপনি পরিবর্তন আনতে পারবেন না। কোরিয়া, চীন শিক্ষায় ১২ শতাংশ দেয়। আর ২ শতাংশও দিতে পারি না। গণতন্ত্র আড়াল করে অনেক দেশ ব্যর্থও হয়েছে। লিবিয়া, ইরাককেও সামনে আনতে হবে। খারাপ উদাহরণও আনা দরকার।
জাগো নিউজ : সামনে বাজেট। বাজেট আলোচনায় কী বলবেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশের বাজেট আলোচনা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার আছে বলে মনে করি না। বাজেট আলোচনা এখন তথাকথিত। উন্নয়ন আলোচনার মতো বাজেট আলোচনা। কারণ বাজেটের সুবিধা সবাই পায় না। জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করে বাজেটের নামে একটি শ্রেণির মানুষকে সুবিধা করে দেয়া হচ্ছে। প্রকল্প হয়, সে প্রকল্পের সুবিধা সাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছায় না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন