ঋণখেলাপিরা অচিরেই ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ পাবেন। এক শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়েই পুনঃতফসিল করা যাবে। পুনঃতফসিল হওয়া ঋণ পরিশোধে তারা সময় পাবেন টানা ১৫ বছর। ফলে প্রথম ২ বছর কোনও কিস্তিই দিতে হবে না। খেলাপিরা ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়া শুরু করলে পাবেন সুদের বিশেষ সুবিধা। নিয়মিত গ্রাহকদের চেয়েও তাদের কম সুদ দিতে হবে। ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহকদের ১২-১৬ শতাংশ হারে সুদ দিতে হলেও চিহ্নিত ঋণখেলাপিদের দিতে হবে মাত্র ৭ শতাংশ হারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির প্রস্তাবে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত নিয়ে কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ঋণ পুনঃতফসিলের বিভিন্ন সুপারিশ করেছে।
তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সোমবার (২৫ মার্চ) শেরেবাংলা নগরে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের জানান, যারা ঋণ শোধ করতে না পারার ‘যৌক্তিক’ কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন, তাদের মোট ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৭ শতাংশ সুদে ১২ বছরে ওই টাকা পরিশোধের সুযোগ পাবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সদস্য অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত নিয়ে সুপারিশটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা রয়েছে। পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়ার একটি প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। তবে এটা বাস্তবায়িত হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির পর।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত ঋণ গ্রহীতাদের বেইল আউট বা মন্দ ঋণকে ভালো ঋণে রূপান্তরিত করার সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কমিটি ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে মতামত দেয়।
তবে বিষয়টির বিরোধিতা করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ডাউন পেমেন্ট দেওয়ার মাধ্যমে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সদিচ্ছা প্রকাশ পায়। বিনা ডাউন পেমেন্টে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা এর অপব্যবহার করতে পারেন। ঋণ শৃঙ্খলার স্বার্থে ঋণ স্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বল্পমাত্রায় হলেও বিভিন্ন হারে ডাউন পেমেন্ট ধার্য করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামতের ভিত্তিতে ডাউন পেমেন্টে ঋণ স্থিতির ১ শতাংশ অথবা এক কোটি টাকা জমা করে আবেদন নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
কমিটি ঋণ পরিশোধের সময়কাল বেঁধে দিয়েছে ১৫ বছর পর্যন্ত।
কমিটি জানিয়েছে, এই ১৫ বছরের মধ্যে দুই বছর ঋণের কোনও কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এটি করা হলে ব্যাংকের তারল্য সংকটসহ মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এতে আমনতকারীদের স্বার্থও ক্ষুণ্ন হতে পারে। ব্যাংক ব্যবসায় পরিচালনার জন্য দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমানতকারীদের স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয় সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই ঋণ দেওয়া ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব। দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে আমানতের মেয়াদকালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঋণের প্রকৃতি ভেদে (চলমান, তলবি, মেয়াদি) পরিশোধের মেয়াদকাল করা হয়ে থাকে। অতিরিক্ত বর্ধিত মেয়াদে ঋণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও জানিয়েছে, অতিরিক্ত বর্ধিত মেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হলে নিয়মিত ঋণগ্রহীতারাও ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হতে চাইবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধের সময়কাল চলতি মূলধন ঋণের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৬ বছর এবং মেয়াদি ঋণের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর করার পরামর্শ দিয়েছে।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরামর্শ আমলে নেওয়া হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতে দরকার সুশাসন। এই সুশাসন আনা সম্ভব হলে এমনিতেই খেলাপি কমে আসবে। খেলাপিদের জন্য এত সুবিধা না দিয়ে যারা নিয়মিত টাকা ফেরত দেয় তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘একটি শ্রেণি আছে যারা ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে পুনঃতফসিলের সুযোগ খোঁজে। আবার ব্যালেন্সশিটে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে ব্যাংকগুলো নিজেরাও ঢালাওভাবে বড় কিছু গ্রাহককে ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দেয়।’
ঋণে সুদহারের ক্ষেত্রে কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ৭ শতাংশ হিসাবে সরল সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিল হবে বলে প্রস্তাব করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে বলেছে, ব্যাংকের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আমানত ও ঋণের সুদহার চক্রবৃদ্ধি হারে নির্ধারণ করা হয়। সরল সুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি বিদ্যমান বাজার তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদ হিসাবায়ন নীতিমালার (বিআরপিডি সার্কুলার নং-২৭, তারিখ ৩১ আগস্ট ২০১০ ও বিআরপিডি সার্কুলার লেটার নং-১৪, তারিখ ৭ ডিসেম্বর, ২০১০) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ব্যাংক ব্যবসায় ‘কস্ট অব ফান্ড’ একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। বিশেষ খাতের ঋণগ্রহীতাদের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের পুনঃতফসিল সুবিধার হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত বিদ্যমান সব নীতিমালার পাশাপাশি ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনা, কস্ট অব ফান্ড ও তারল্য অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রতিবেদনটিতে কমিটি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের পক্ষে প্রস্তাব করেছে। কমিটি বলেছে, কিস্তির মধ্যে আসল ও সুদের পরিমাণ মোট আসল ও সুদ আনুপাতিক হারে আদায়যোগ্য হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে কিস্তি নির্ধারণ হতে পারে।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় ডাউন পেমেন্ট ও মেয়াদের শর্ত শিথিল করে পাঁচশ কোটি টাকার ওপরে ঋণ নেওয়া ১১টি ব্যবসায়ী গ্রুপকে দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা। ওই সময় তারা ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠিত ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ায় সুদে-আসলে ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৯৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন