সড়ক দুর্ঘটনা কিছুতেই থামছে না। প্রতিদিনই কারো না কারো প্রাণ ঝরছে সড়কে। দিন দিন পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর হচ্ছে যে সড়কের নাম শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠছে। রাস্তায় বের হয়ে কেউ নিরাপদে বাসায় ফিরবে এরকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, সড়ক যেন নরকে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন গত মঙ্গলবার।
এরপর গত পাঁচ দিনে সড়কে আরও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু গত মঙ্গলবারের পর গত শনিবার আরও এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী প্রাণ হারানোয় মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। সড়কে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তারা। গত শনিবার নিহত হন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ওয়াসিম তাহসিন। অভিযোগ উঠেছে ওয়াসিমকে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় বাসের চালক এবং হেলপারকে আটক করা হয়েছে। তারা হত্যার বিষয়টি স্বীকারও করেছে।
জানা গেছে, গত শনিবার সকালে ময়মনসিংহের সরিষাবাড়ী থেকে সিলেটগামী যাত্রীবাহী বাস উদার পরিবহনযোগে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থেকে শেরপুরে আসছিলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওয়াসিম। ভাড়ার টাকা নিয়ে হেলপার ও চালকের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে বাস চালকের নির্দেশে হেলপার শিক্ষার্থী ওয়াসিমসহ দুজনকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। এ সময় ওয়াসিম ও অন্য শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। আহত দুজনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর বিকাল সাড়ে ৪টায় ওয়াসিম মারা যান। এ ঘটনায় সিলেটসহ সারা দেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। বিভিন্ন স্থানে বাসে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
সিকৃবির চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াসিম তাহসিনকে হত্যার ঘটনার পর বাসের চালক এবং তার সহকারীকে (হেলপার) আটক করেছে পুলিশ। বাসের চালক জুয়েল আহমদকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এবং হেলপার মাসুক আলীকে সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে আটক করা হয়।
গত শনিবার রাত ৩টার দিকে মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ছাতক উপজেলার সিংচাপইড় ইউনিয়নের সিংচাপইড় গ্রামে শ্বশুরবাড়ি থেকে হেলপার মাসুককে আটক করে সুনামগঞ্জ পুলিশ। তিনি সুনামগঞ্জ পৌর শহরের তেঘরিয়া এলাকার মৃত দৌলত আলীর ছেলে।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার বরকতুল্লাহ খান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে হেলপার মাসুক আলীকে শ্বাসরুদ্ধকার দেড় ঘণ্টার অভিযানের মাধ্যমে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে আটক করা হয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বাসের সুপারভাইজারকে ঘটনার জন্য দায়ী করেন।
এর আগে সিলেট দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ শনিবার রাত ১১টার দিকে কদমতলী বাসটার্মিনাল এলাকা থেকে গাড়ির চালক জুয়েল আহমদকে আটক করে। তিনি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থানার বাড়াউরা গ্রামের মৃত আজিদ মিয়ার ছেলে।
সিকৃবি শিক্ষার্থী মো. ওয়াসিম আব্বাসকে বাস থেকে ফেলে হত্যার প্রতিবাদে গতকাল সড়ক অবরোধ করেছেন ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সিকৃবিসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সিলেট নগরের চৌহাট্টা মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের মুখে পড়েন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এ অবস্থায় আবুল মাল আবদুল মুহিত গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে আসেন শিক্ষার্থীদের মঞ্চে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন তিনি। ভালোবাসা দিয়ে মন জয় করেন শিক্ষার্থীদের।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আমি শুনেছি শনিবার একটি বাসের চালক ও হেলপারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার জেরে এক শিক্ষার্থীকে বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এতে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এটি নিশ্চিত একটি হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আবুল মাল আবদুল মুহিত আরও বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করবেন আদালত। তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আমার মতে শনিবারের ঘটনা একটি পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এখন আদালতকে তার সঠিক কাজটি করার সুযোগ দিতে হবে। আমি তোমাদের দলে, তোমাদের সব দাবির সঙ্গে একমত। আমিও এসব দাবির বাস্তবায়ন চাই, নিরাপদ সড়ক চাই। কেউ সড়কে মারা যাক আমরা চাই না।
এর আগে দুপুর ১২টা থেকে শিক্ষার্থী ওয়াসিম হত্যার প্রতিবাদে নগরীর চৌহাট্টায় অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অবরোধে চৌহাট্টার চারদিকে শত শত গাড়ি আটকা পড়ে। দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চৌহাট্টায় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের গাড়ি পৌঁছালে অবরোধের মুখে পড়ে। এ সময় মুহিতের গাড়ি দেখেও রাস্তা ছাড়েননি শিক্ষার্থীরা। পরে মুহিতের গাড়ি থেকে নেমে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে শিক্ষার্থীরা তাদের অবস্থানে ছিলেন অনড়। তারা ওয়াসিম হত্যার বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ তুলবেন না, কোনো গাড়ি ছাড়বেন না বলে জানান।
এ অবস্থায় আবুল মাল আবদুল মুহিতের গাড়ির পেছনে থাকা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আশফাক আহমদ গাড়ি থেকে নেমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং মুহিতের গাড়ি ছাড়তে অনুরোধ জানান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কোনো কথাই শোনেননি। তাদের দাবি একটাই, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
শেষ পর্যন্ত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গাড়ি থেকে নেমে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দেন। পরবর্তীতে মুহিতের গাড়ি ছেড়ে দেন শিক্ষার্থীরা। এখন সবার কাছে প্রশ্ন সড়কের পরিস্থিতি এমন কেন হলো। এই পরিস্থিতি থেকে মানুষ কবে পরিত্রাণ পাবে। নাকি কোনো দিনই এ থেকে পরিত্রাণ পাবে না।
জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৮ লাখের বেশি। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য লাইসেন্সধারী চালক আছেন প্রায় ২০ লাখ। অর্থাৎ ৪৭ শতাংশের বেশি গাড়ি চলছে ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত চার বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৯ হাজার ৩১৫ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে সড়কে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে মারা গেছেন ৭ হাজার ২২১ জন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব বলছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ৪২২টি। আর বিআরটিএ সূত্র বলছে, বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য চালক লাইসেন্স আছে প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে একই লাইসেন্সে একজন ব্যক্তি মোটরসাইকেল ও অন্য যানবাহন চালান। এদের বাদ দিলে চালকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ। অর্থাৎ ১৮ লাখ যানবাহন ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে চলছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন