নতুন করে গ্যাসের মূল্য সমন্বয়ের উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশ অ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গত ১১ মার্চ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা চারদিন কাওরানবাজারে টিসিবি অডিটোরিয়ামে গণশুনানি আয়োজন করে।
]সেখানে প্রায় প্রতিদিনই ভোক্তা, শিল্প মালিক ও বিশেষজ্ঞরা গ্যাসের দাম বাড়ানোর এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন। প্রত্যেকেই নানা যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন এখন গ্যাসের দাম বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত হবে না।
কিন্তু তার পরও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে অনড় আছে পেট্রোবাংলা। গতকাল গণশুনানির শেষ দিনে উপস্থিত হয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) হারুন উর রশীদ বলেছেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়াতেই হবে; না বাড়িয়ে কোনো উপায় নেই। কারণ প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) এলএনজি আমদানি করায় গত ৯ মাসে ৯ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে পেট্রোবাংলার।’
ফলে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনড় থেকে অযথা গণশুনানি আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। ১১ মার্চ গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির হুইলিং চার্জ বৃদ্ধির আবেদনের ওপর শুনানি নেওয়া হয়।
এর পর পর্যায়ক্রমে ৬টি বিতরণ কোম্পানির গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানি করা হয়। এ সময় প্রত্যেক কোম্পানিই ১০২ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। যার প্রধান কারণ দেখানো হয়, চড়া দরে এলএনজি আমদানি।
গতকালও কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এবং পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানির গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ওপর শুনানি হয়। সেখানে অংশ নিয়ে ভোক্তারা গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইন বন্ধ, বাপেক্সকে শক্তিশালী করা, দেশীয় গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম জোরদার করার প্রস্তাব দেন। শুনানিতে পেট্রোবাংলার পরিচালক আরও বলেন, আমরা মুনাফা করতে চাই না। আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে চাই, আপনারাও চান।
সে কারণে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। আর তা আমদানি করতে হলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। দেশীয় তেল-গ্যাস আহরণে সেভাবে কাজ না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। সাগরে তেল-গ্যাস আহরণে আমাদের অভিজ্ঞতা নেই। আমরা চাচ্ছি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে। কিন্তু আমাদের মডেল পিএসসির প্রাইস আকর্ষণীয় নয়।
সে কারণে সংশোধনীতে প্রাইস আকর্ষণীয় করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই এটি চূড়ান্ত করা হবে। শুনানিতে সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, সিএনজি খাতে আপনারা ৩২ টাকা থেকে দাম ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৮ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন। এর প্রভাব কী হতে পারে আপনারা ভাবছেন না। ঢাকায় এক সময় কালো ধোঁয়ার কারণে থাকা যেত না।
সে কারণে সিএনজিতে যাওয়া হয়। আমরা অনেকে বিনিয়োগ করি। এখন বলা হচ্ছে তেলের দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। একবারও কি ঢাকার পরিণতির কথা ভাবছেন? দাম বেড়ে গেলে গাড়ি ভাড়া বেড়ে যাবে। এতে অরাজকতা দেখা দিতে পারে। দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। শুধু ফারহান নূর নয় গত কয়েকদিনে দেশের সব সেক্টরের ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ, বাম রাজনৈতিক দলের নেতারা সবাই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছেন। তারা বলছেন, দাম না বাড়িয়ে আগে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর উচিত চুরি, দুর্নীতি, সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণে আনা।
দুর্নীতির কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে শুনানিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব জহির রায়হান বলেন, আমরা একদিনে বিপ্লব করতে পারব না। একটু একটু করে এগিয়ে যেতে পারলে ভালো। দুর্নীতি অনেকের মজ্জাগত দোষে পরিণত হয়েছে। এটাকে থামানোর জন্য কাজ চলছে। এর মধ্যেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার অনুরোধ করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম।
বিতরণ কোম্পানি যত বেশি দাম বাড়ানোর আবেদন করুক না কেন যৌক্তিক পর্যায়ে বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। মনোয়ার ইসলাম বলেন, আপনারা যদি অতীতের দিকে তাকান দেখবেন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো যাই বলুক যৌক্তিক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে।
২০১৭ সালে তারা ৯৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল, বিইআরসি ১১ শতাংশ বাড়িয়েছিল। ২০১৮ সালে ৭৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিপরীতে কোনো দাম বাড়ানো হয়নি। আমরা সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। নোটও করা হয়েছে। কমিশন পুরোপুরি স্বাধীন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবে। তবে আমরা কখনো কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি।
দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবে ভোক্তাদের ওপর চাপ বেড়ে যায়। সে কারণে তারা স্বাভাবিক কারণেই অসন্তুষ্ট হন। তিনি বলেন, গণশুনানিতে অনেক সুপারিশ এসেছে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বলব বিষয়টি দেখার জন্য। স্থানীয় পর্যায়ে গিয়ে গণশুনানি করার যে প্রস্তাব এসেছে বিইআরসি তা বিবেচনা করবে। বিতরণ কোম্পানিগুলো বিদ্যুতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩.১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯.৭৪ টাকা, সিএনজিতে ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৮.১০ টাকা, প্রি-পেইড মিটারে ৯.১০ (ঘনমিটার) টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬.৪১ টাকা করার প্রস্তাব করেছে।
আবাসিকে এক চুলার দর ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫০ টাকা, দুই চুলা ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৪০ টাকা, সার উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার ২.৭১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.৪৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯.৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮.০৪ টাকা, শিল্পে ৭.৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪.০৫ টাকা, বাণিজ্যিকে ১৭.০৪ টাকার পরিবর্তে ২৪.৫ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। এদিকে গণশুনানির সময়ই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে গতকাল টিসিবি ভবনের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
ফলে এদিন বিইআরসির নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। অন্য দিনের তুলনায় এদিন টিসিবি ভবনে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন দেখা গেছে। এ ছাড়া গ্যাসের দাম বাড়লে আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে গণফোরাম। গণমাধ্যমে পাঠানো দলের তথ্য ও গণমাধ্যম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পথিকের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন