জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ কার্বন-ডাই অক্সাইডসহ গ্রিন হাউস গ্যাস। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এসব গ্যাস নিঃসরণে সিংহ ভাগ দায়ী হলেও ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম সারিতে। নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও জলবায়ুজনিত উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের সংখ্যা বর্তমানে কয়েক লাখ। বিশ্বব্যাংক বলছে ২০৫০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৩৩ লাখে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, খরা-এসব কারণে বাংলাদেশে দিনে দিনে বাড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু। উপকূলীয় অঞ্চলসহ এসব উন্মূলিত মানুষ জীবিকার তাগিদে আশ্রয় নিচ্ছেন রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে। ফলে এসব শহরে কর্মসংস্থান ও পরিবেশের ওপর অব্যাহতভাবে চাপ পড়ছে। দিনে দিনে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু ধারণা এখন কাগজে-কলমে বন্দি। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এ নিয়ে উদ্যোগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। ঘরবাড়ি, জমি, বসতি ও জীবিকা হারানো জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের উদ্যোগও সীমিত। এদের মধ্যে যাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে তাদেরও লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো চরে বা দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে জীবনধারণ ও জীবিকার সুবিধা সীমিত হওয়ায় তারা নগরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছেন।
গত বছরের মার্চ মাসে বিশ্বব্যাংকের ‘প্রিপেয়ারিং ফর ইন্টারনাল ক্লাইমেট মাইগ্রেশন’ প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ২০৫০ সালের মধ্যে এ দেশের ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ স্থানীয়ভাবে জলবায়ু শরণার্থী হবে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুয়ায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর, বিশেষ করে এশিয়ার শহরগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর যে দুটি শহরের জনসংখ্যা আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাবে সে দুটি শহর হল ঢাকা এবং চট্টগ্রাম। খুলনাও খুব একটা পিছিয়ে থাকবে না। যদিও বাংলাদেশের কিছু অংশ নদীবাহিত পলির কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঁচু হতে থাকবে, তবে এক-পঞ্চমাংশ অংশ তলিয়ে যাবে পানির নিচে।
ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কয়েক ফুট বেড়ে গেলে প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়বে। জলবায়ু শরণার্থী হিসেবে এ বাস্তুহারা মানুষগুলো মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড চাপ ফেলবে দেশের সরকার, এর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সীমান্ত এলাকাগুলোতে। গণহারে অভিবাসনের মতো একটি ভূ-রাজনৈতিক ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই প্রবল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়ের হিমবাহের বরফগলা পানি সাধারণত নদ-নদীগুলোর বাৎসরিক পানিপ্রবাহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূমিধস, ফ্লাশ ফ্লাড এবং পাহাড়ি হ্রদগুলোর উপচে পড়ারও কারণ ঘটিয়ে থাকে। তাই হিমালয়ের বরফ গলে প্রতি বছরই বাংলাদেশে মৌসুমি বন্যা হয়ে থাকে। এ মৌসুমি বন্যাগুলো দিনকে দিন আরও ভয়াবহ রূপধারণ করছে। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চল পড়ে যায় খরার কবলে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, ফসলি জমি পানিতে ডুবে যাওয়া কিংবা ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমে যাওয়া- এসব কিছুই খাদ্য উৎপাদনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি শিল্প-কারখানা আর বসতবাড়ি নির্মাণে গ্রাস করছে আবাদি জমি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে এখনো সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। খুব দ্রুতই এ বিষয়ে প্রস্তুতি না নিলে সংকট বাড়বে বহুমাত্রিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন