বরগুনার আমতলী উপজেলার মহিষডাঙার আবাসিক এলাকায় ৮ বছর আগে ইভাটা নির্মাণ করেন সোবাহান কাজী। ইটভাটা নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসনের অনুমোদন কোনোটাই নেননি তিনি। তারপরও প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, অবৈধ ইটভাটার কারণে ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ এবং বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
এ বিষয়ে ভাটা মালিক সোবাহান কাজীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি প্রথমে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদককে। তাতেও কাজ না হওয়ায় স্থানীয় আরেক ইটভাটা মালিক হারুনকে দিয়েও টাকার লোভ দেখিয়ে ম্যানেজের চেষ্টা করেন। পরে কথা প্রসঙ্গে সোবাহান কাজী বলেন, ‘সব বিভাগকে ম্যানেজ করেই ইটভাটা চালাচ্ছি। আমি তো সবাইকেই খুশি করি। আমার এখানে এসে কেউ খালি হাতে যেতে পারে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সালে মহিষডাঙা এলাকায় ফসলি জমিতে ড্রাম চিমনি ব্যবহার করে অবৈধভাবে এমসিকে ইটভাটা গড়ে তোলেন সোবাহান। বিভিন্ন সময় পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইটভাটাটিতে অভিযান চালালেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন-২০১৩ তে উল্লেখ আছে,কোনোভাবেই ড্রাম চিমনি ব্যবহার করে ইটভাটা করা যাবে না। আইনের ৬ ধারায় উল্লেখ আছে, কোনও ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো যাবে না। কিন্তু এই ইটভাটাটিতে করাত কল বসিয়ে কাঠ কেটে পোড়ানো হচ্ছে ইট।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে,স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের রাস্তার পাশে থাকা ইটভাটাটির ১ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইটভাটায় করাত কল বসিয়ে কাটা হচ্ছে কাঠ। সেই কাঠ দিয়েই ড্রাম চিমনি ব্যবহার করে পোড়ানো হচ্ছে ইট। এছাড়া ভাটায় কাজ করছে শিশুরা।
শুধু এমসিকে ইটভাটাই নয়, আমতলী উপজেলায় সাতটি ইউনিয়নে ১১ ইটভাটায় ড্রাম চিমনি ব্যবহার করে পোড়ানো হচ্ছে ইট। এতে করে মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর ও বনবিভাগের লোকজন দেখেও না দেখার ভান করছেন। প্রতিবছর ইট বানানোর মৌসুম শুরু হলে বিভিন্ন দফতর থেকে লোকজন এসে ইটভাটাগুলো থেকে টাকা নিয়ে যায়। বেশি অসুবিধা হলে বছরে একবার অভিযান চালিয়ে এসব ভাটা ভাঙা হয়। কিন্তু পরদিন থেকেই আবার পুনরায় চালু হয় তা।
এ বিষয়ে স্থানীয় আবদুর রহমান সালেহ বলেন, ‘এমসিকে ভাটার কারণে পরিবেশের পাশাপাশি নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা হচ্ছে। তাই প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ থাকবে এই ভাটাটিকে যেন তারা দ্রুত অপসারণ করে।’
বরগুনার সরকারি মহিলা কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খালেদা জান্নাতী বলেন, ‘ড্রাম চিমনি ব্যবহার করে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ালে নির্গত ধোঁয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনো-অক্সাইড বেশি থাকে। এই গ্যাস দুটো পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ থেকে মানুষের শ্বাসকষ্ট,অ্যাজমা ও ফুসফুসের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়।’
স্থানীয় আইনজীবী মিজানুর রহমান শিকদার জানান, ‘আমতলীতে অনেক ইটভাটা আছে যেখানে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়। কিন্তু প্রশাসন এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে স্থায়ী কোনও ব্যবস্থা নেয় না। ফলে ভাটা মালিকরা তাদের ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছেন বহাল তবিয়তে।’এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটা ধ্বংস করতে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। সরকারের অনুমোদন না নিয়ে কেউ ইটভাটা পরিচালনা করতে পারবে না। সেই সঙ্গে অনুমোদিত কোনও ইটভাটায় যদি পরিবেশ অধিদফতরের নিয়ম উপেক্ষা করা হয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবেশের ক্ষতি সাধন হয় এরকম কোনও ইটভাটাকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
১১ ইটভায় কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে ইটভাটাগুলো একটু দূরে হওয়ায় অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। তবে পর্যায়ক্রমে সব ইটভাটায় অভিযানে যাওয়া হবে।’
প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ইটভাটা পরিচালনা করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবৈধ কার্যক্রমের জন্য প্রশাসনকে ম্যানেজ করার কোনও সুযোগ নেই। অবৈধ ইট ভাটা মালিক যতই শক্তিশালী হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’বরিশাল পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক আবদুল হালিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুধু বরগুনা নয়, সব ইটভাটায় অবৈধ তালিকা করে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশের জবাব পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলাতেই আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। বেশ কিছু অবৈধ ইটভাটায় জরিমানা করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমতলীতে ১১টি অবৈধ ইটভাটার তালিকা আমাদের কাছে আছে। দু’টি ইটভাটাকে জরিমানাও করা হয়েছে। আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভূমি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। শিগগিরউ বাকি ইটভাটাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
ইটভাটা মালিকের দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতরের অফিসে এসে কেউ আমাদের ম্যানেজ করবে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। তবে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ আছে কিনা সেটা আমার জানা নেই।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন