মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস; এখানে পাসপোর্ট তৈরিতে ঝাড়ুদারকেও দিতে হয় টাকা। অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-অফিস সহকারী-পিয়ন-ঝাড়ুদার—সবাই যেন একসূত্রে গাথা। সবাইকে খুশি করতেই পারলেই মেলে পাসপোর্ট।
সম্প্রতি এ অভিযোগ উঠেছে মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
এই অফিসের পরিচালক থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার—সবাই আছেন এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। পাসপোর্ট-প্রতি ৮০০ থেকে এক হাজার ৫০০ পর্যন্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ পাসপোর্ট করতে এসে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
সকাল ১০টা থেকে মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্টের কাগজপত্র জমা নেওয়া শুরু হয়। চলে দুপুর ১টা পর্ষন্ত। অভিযোগ রয়েছে—এ সময়ের মধ্য বেশির ভাগ মানুষের কাগজপত্রের ভুল ধরে জমা নেওয়া হয় না। বাইরে অপেক্ষমাণ দালাল ও অফিসের কর্মচারীদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে টাকায় মেলে এসব ভুলের সমাধান। সব ভুল ঠিক করে বিকেল তিনটার পর জমা নেওয়া হয় কাগজপত্র। আর এ টাকার ভাগ ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে পরিচালক পর্যন্ত যায়।
এই প্রতিবেদক নতুন পাসপোর্ট তৈরির নাম করে অফিসের ঝাড়ুদার বিপ্লবের মুঠোফোনে যোগাযোগ শুরু করেন। একপর্যায়ে এক হাজার টাকার বিনিময়ে দ্রুততম সময়ে পাসপোর্ট তৈরি করে দেবে বলে চুক্তি হয়।
মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মচারী নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, সকালে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় ফাইলে যোগাযোগের জন্য ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে পরে যোগাযোগ করে আসতে পারে। ফাইলে দেওয়া সেই মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে আবার সেই ফাইল জমা নেওয়া হয়।
অভিযোগের তির অফিস সহকারী রফিকের দিকে। তিনিই এই কাজের মূলহোতা। তার কথামতো সবকিছু চলে। পরিচালকের সই ছাড়া কোনো পাসপোর্টের কাগজপত্র জমা নেওয়ার নিয়ম নেই।
কিন্তু রফিক টাকার বিনিময়ে নিজেই ফাইলে সই করে জমা নিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তার বিরুদ্ধে পরিচালকের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়। বাদ যাননি পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরা।
এ ব্যাপারে পাসপোর্ট দালাল বকুল ও বাবুল জানান, আমরা পাসপোর্ট করতে গ্রাম থেকে পাসপোর্টের ফাইল নিয়ে অফিসে যাই। প্রতি ফাইলে অফিসে আমাদের ৮০০ টাকা দিতে হয়। জরুরি পাসপোর্টে এক হাজার ২০০ টাকা লাগে।
টাকা দিলে ফাইলের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হয় না। সরাসরি জমা হয়ে যায়। টাকা নিয়ে থাকেন অফিস সহকারী রফিক, পিয়ন মুন্না ও ঝাড়ুদার বিপ্লব।
অভিযোগ আছে— টাকার বিনিময়ে একাধিক মামলার আসামির পাসপোর্টও এই অফিস থেকে তৈরি করার।
কেস স্টাডি
মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা গ্রামের বাসিন্দা ইয়াকুব আলী জানান, তার ছেলে বিদেশ যাবে বলে নিজে পাসপোর্টের ফাইল পূরণ করে জমা দিতে এসে জমা দিতে পারেনি। পরে দালালের মাধ্যমে অফিসে এক হাজার টাকা দিয়ে দিয়ে ফাইল জমা দেয়।
এ ছাড়া একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, যতই ফাইল নিখুঁতভাবে পূরণ করে নিয়ে আসা হোক না কেন—এখানে এসে সেটার ভুল ধরবে। আবার ভুল সংশোধন করে জমা দিলেও লাভ হয় না। নানা অজুহাতে ঘুরিয়ে দেবে। কিন্তু টাকা দিলে কাগজপত্র ভুল থাকলেও সমস্যা নেই।
মেহেরপুর গাংনী উপজেলার পশ্চিম মালশাহদাহ গ্রামের ক্যানসারের রোগী আবদুল বারি। ভারতে যাবেন চিকিৎসার জন্য। পাসপোর্ট অফিসে ঘুরছেন তিন দিন ধরে। অসহায় ওই ব্যক্তি দুপুরে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের টাকা দিলে, মিলেছে পাসপোর্ট করার সুযোগ।
শুধু আবদুল বারিই নন, ছোটখাটো ভুলের জন্য ভুক্তভোগীদের ঘুরতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই।
হাতেনাতে ধরা
গত ৯ জানুয়ারি সকালে পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের টাকা নিতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়েন ওই অফিসের কর্মকর্তারা। তোপের মুখে পড়েন অফিসের এডি গোলাম ইয়াছিন। পরে এনডিসি রকিবুল হাসান ঘটনাস্থলে গিয়ে জনতাকে শান্ত করেন। এবং দোষীর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক গোলাম ইয়াছিন জানান, এ ঘটনার পর দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ওপর মহলে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন