কবির য়াহমদ
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজের মানসিক স্থিতিহীনতা কিংবা অসুস্থতার কথা স্বীকার করে দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই স্বীকারোক্তি এলো তার নিজের সংবাদ সম্মেলনে। দেশের সেনাপ্রধানকে নিয়ে অসত্য, মানহানিকর ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি। আগের বক্তব্যকে থেকে ইউটার্ন নিয়ে এবার তিনি প্রশংসায় ভাসিয়েছেন সেনাপ্রধানকে।
ডা. চৌধুরীর শনিবারের সংবাদ সম্মেলন ছিল ৯ অক্টোবর রাতে সময় টেলিভিশনে দেওয়া তার অসত্য বক্তব্যের দায় শোধের। সে দিন তিনি দাবি করেছিলেন, “বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এক সময় ‘চট্টগ্রামের জিওসি’ ছিলেন এবং ওই সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে ‘সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ চুরি হয়েছিল’, যে ঘটনায় আজিজ আহমেদের ‘কোর্ট মার্শাল’ হয়েছিল।” এরপর সেনাসদর থেকে বিবৃতি আসে, প্রতিবাদের। সেই প্রতিবাদ যে অসত্য ছিল না সেটা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সংবাদ সম্মেলন থেকেই স্পষ্ট আর প্রমাণিত।
তার সেই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে শুক্রবার সেনাসদরের প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, “বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ চাকরি জীবনে কখনোই চট্টগ্রামের জিওসি বা কমান্ড্যান্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন না। তিনি সেপ্টেম্বর ২০১০ হতে জুন ২০১১ পর্যন্ত কুমিল্লায় ৩৩ আর্টিলারি ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন, জুন ২০১১ হতে মে ২০১২ পর্যন্ত ঢাকার মিরপুরে ৬ স্বতন্ত্র এডিএ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার এবং মে ২০১২ হতে ডিসেম্বর ২০১২ পর্যন্ত কুমিল্লায় ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণিত সময়ে চট্টগ্রাম বা কুমিল্লা সেনানিবাসে কোনো সমরাস্ত্র বা গোলাবারুদ চুরি বা হারানোর কোনো ঘটনা ঘটেনি। …বর্তমান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ তার দীর্ঘ বর্ণাঢ্য সামরিক চাকরি জীবনে কখনোই কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হননি।”
এরপর পরই ভুল ভাঙে ডা. চৌধুরীর। সংবাদ সম্মেলনে ‘ভুল বক্তব্য’ ও ‘শব্দ বিভ্রাটে’ দুঃখপ্রকাশে জানালেন, “টেলিভিশনে আলোচনাকালে আমি দেশের বর্তমানে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ সম্পর্কে অসাবধানতাবশত একটি ভুল তথ্য উল্লেখ করেছিলাম। জেনারেল আজিজ একজন দক্ষ আর্টিলারি সেনা কর্মকর্তা। তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ‘জিওসি’ ছিলেন না ‘কমানডেন্ট’ও ছিলেন না। তিনি তার কর্মজীবনের এক সময়ে চট্টগ্রাম সেনাছাউনিতে আর্টিলারি প্রশিক্ষক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল হয়নি”।
এই ভুলের স্বীকার সেনাসদরের কড়া প্রতিবাদ কিংবা সেনাবাহিনীকে ভয় পেয়ে এমন ভাবার কারণ নাই। যার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল হয়নি তাকে এমন অপবাদ দেওয়া মানহানির, এবং এই মিথ্যা তথ্য টেলিভিশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে এটা রীতিমত অপরাধ। কেবল টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকেরাই নন ওই ক্লিপের প্রচার হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। এতে করে সংশ্লিষ্ট সেই টেলিভিশন চ্যানেলের যত দর্শক নিয়মিত ছিল তাদের বাইরে অগণন মানুষের কাছে পৌঁছেছে এই অসত্য বক্তব্য। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধানের মানহানিও হয়েছে। একই সঙ্গে সেনাপ্রধানের কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতায় কালির প্রলেপ পড়েছে। সেনাবাহিনী প্রধানকে কেবল একজন ব্যক্তি হিসেবেই এখানে ভাবলে চলবে না, এই পদটা একটা প্রতিষ্ঠানও। সেক্ষেত্রেও এই অসত্য বক্তব্য সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তির সঙ্গেও সম্পৃক্ত। এই অসত্য বক্তব্যের কারণে ভাবমূর্তিজনিত যে ক্ষতি হলো সেটাও ধর্তব্যের।
টেলিভিশনে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য বক্তব্যের তিনদিনের মাথায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজের ভুল স্বীকার করেছেন, দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এটা শুভলক্ষণ। এই দুঃখপ্রকাশ না করলেও মিথ্যা বক্তব্য যে সত্য বলে সুস্থ চিন্তার মানুষেরা বিশ্বাস করত তা না। তবে সুস্থ চিন্তার মানুষদের বিপরীতে দেশে অসুস্থ চিন্তার মানুষদের সংখ্যা কম না, বলা যায় অনেক-অনেকই। এই মানুষগুলো সেই অসত্য বক্তব্যকে সত্য বলে ভেবে নিয়েছে, প্রচারও করেছে। তাদের কাছে এই ভুল স্বীকার-দুঃখপ্রকাশের বার্তা পৌঁছাবে না। পৌঁছালেও আবার এখানে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করবে, যদিও অমূলক সেই সন্দেহ তবু সন্দেহ করবেই। তাদের এই সন্দেহ দূর হবে না কোনোদিনও। এর বাইরে আছে টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখা সেই অগণন দর্শক যাদের কাছে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হালনাগাদ বক্তব্য কতখানি পৌঁছাবে এনিয়ে আমি সন্দিহান। পৌঁছাবে না শতভাগ, বলা যায় এমন। ফলে মানহানি যা হওয়ার ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে সেনাপ্রধানের, একই সঙ্গে সেনাবাহিনীরও।
এখানে সংশ্লিষ্ট টেলিভিশন চ্যানেলের কতখানি দায়? হয়ত বলবেন অনেকেই- দায় আছে। তবে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের আলোচকদের বক্তব্য এডিটিংয়ের সুযোগ থাকে না, থাকেওনি এক্ষেত্রে। এই সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে এখন তবে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি, এবং সেই সতর্কতা হতে পারে আলোচক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এক্ষেত্রে আলোচক বাছাইয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। প্রাসঙ্গিক বিষয়ের কথা বলার যোগ্যতা যারা রাখেন তাদেরই আমন্ত্রণ জানাতে পারে স্টুডিওতে। তবে অবাক বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আলোচকদের প্রায় একই মুখ; চ্যানেলে-চ্যানেলে ঘুরে-ঘুরে বেশিরভাগই সকল বিষয়ে মতামত দেন। এক-একজন ব্যক্তি সকল বিষয়ে এত অভিজ্ঞ হয়ে কী করে?
Advertisement
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজের অসুস্থতার বর্ণনা করেছে তার সংবাদ সম্মেলনে। বলছেন, “দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আইনের সংকীর্ণতার কারণে আমার কিডনি রোগের চিকিৎসা সুলভে কিডনি প্রতিস্থাপন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। এ কারণে জীবন রক্ষায় আমাকে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন প্রতিবার চার ঘণ্টা করে হোমডায়ালাইসিস করতে হয়। ডায়ালাইসিসের পর স্বাভাবিক কারণে শারীরিক দুর্বলতা বাড়ে এবং মানসিক স্থিতি কিছুটা কমে”।
এটা তার শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার সরল স্বীকারোক্তি। এই আনুষ্ঠানিক স্বীকারোক্তির পরও আশা করি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মানসিক স্থিতিহীন কাউকে আর কোন আলোচনা অনুষ্ঠান বা টকশোতে আমন্ত্রণ জানাবে না।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এটা তার গৌরবের ইতিহাস। তার সেই পরিচয় মাঝে মাঝে ভুলতে বসি বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, মানবতাবিরোধি অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে তার নানা বিতর্কিত ভূমিকা ও মন্তব্যে। তবে সাম্প্রতিক এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রমাণ হলো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার সেই পরিচয় এখন আড়ালে পড়ে যায় মানসিক অস্থিতি কিংবা অসুস্থতার কারণে। শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার কারণে তিনি এখন যা করছেন, যা বলছেন তা তার আগের সেই পরিচয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা অসুস্থতার প্রভাব!
এমন অবস্থায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উচিত স্বঘোষিত শারীরিক ও মানসিক অস্থিতিধারীকে আর আমন্ত্রণ না জানানো। তার ভুল স্বীকার, দুঃখপ্রকাশ আর শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার স্বীকারোক্তিমূলক সংবাদ সম্মেলনের পর এখন ফের যদি তিনি বিভিন্ন টেলিভিশনে হাজির হন বা তাকে হাজির করা হয় তবে দর্শকেরা হয়ত বলে উঠবে- উনি তো অসুস্থ, মানসিকভাবেও। তার অসুস্থতার এই স্বীকারোক্তি কিন্তু স্রেফ কোন নির্দিষ্ট দিনের নয়, প্রতিদিনের এবং যতদিন তিনি পুরোপুরি সুস্থ না হন, ডাক্তার এবং নিজের ভাষায়।
এরপরেও যদি বিভিন্ন টকশো বা আলোচনা অনুষ্ঠানে তাকে নেওয়া হয় তবে ‘সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান তাই আমাদের করার কিছু নেই বা ছিল না’- এমনটা বলার সুযোগ থাকবে না টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর। এক্ষেত্রে তার যেকোনো অপ্রয়োজনীয়, অসতর্কতামূলক ও দায়িত্বহীন মন্তব্যের ব্যক্তিগত দায় আর দায়িত্বের সঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও যুক্ত হয়ে যাবে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)
পাঠক মন্তব্য
Dr. Jafforullah Choudhury is one of our hero of 1971. The Army Chief is the former chief of "BGB". We know about his performance as a "BGB" Chief. The Armed Forces is a Patriotic Institution. The Army Chief is not an institution. So, ISPR should stay out of politics. If Dr. Choudhury was supplied false information to trap him just as they did in Saudi Arabia to Amardesh and false information about The Chief Justice S.K. Sinha , someday we will know the truth. But The Army should stay out of politics so they can enjoy the love and support of the people. Filing a sedition case against Dr. Jafforullah Choudhury is not going to increase the love and support of the people, but it is misuse of privileges.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন