গত বছর প্রায় গলা সমান পানিতে দাঁড়িয়ে ভারতের পতাকাকে স্যালুট দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল তৃতীয় শ্রেণির ছোট্ট হায়দার আলি খান। এবার সে আসামের দক্ষিণ শালমারার নসকরা নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। এবারও ভারতের স্বাধীনতা দিবসে স্কুলে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে উপস্থিত হায়দার। তবে গতবারের মতো এবার তার মাঝে সেই উচ্ছ্বাসটুকু যেন নেই। থাকবেই বা কী করে? সে যে এখন 'দেশহীন'!
বুধবার ভারতের স্বাধীনতা দিবস। এদিন সকাল ৮টা বাজতে না বাজতেই বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে পৌঁছে যায় হায়দার। স্কুল পরিদর্শক আমির হামজা ও প্রধান শিক্ষক নৃপেন রাহা যখন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছেন, নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট আর আকাশি জামা পরা হায়দার তখন একদৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে। পতাকা তোলা হতেই সবার সঙ্গে বলে উঠল, 'বন্দে মাতরম্', 'জয় হিন্দ', 'ভারত মাতার জয়'।
অথচ, এই হায়দার নিজে আপাতত 'দেশহীন'। সম্প্রতি ভারতের ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স (এনআরসি) আসাম রাজ্যে নাগরিকপঞ্জির সংশোধিত যে খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে নাম নেই হায়দারসহ ওই রাজ্যের ৪০ লাখেরও বেশি বাসিন্দার। স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ হায়দারের। পতাকা উত্তোলনের পর স্কুলশিক্ষক মিজানুর রহমানের চোখেও ধরা পড়ে বিষয়টি। তিনি মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে ছোট্ট হায়দারের জবাব, 'স্যার, নাম ওঠেনি যে। আমার কী হবে?'এমন পাল্টা প্রশ্নের জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না শিক্ষক মিজানুর। তারপরও আশ্বাস দিয়ে হায়দারকে তিনি বলেন, 'চিন্তা কোরো না। ২০ তারিখ থেকে এ বিষয়ে আবেদনপত্র দেওয়া হবে। পূরণ করে জমা দিও। নাম উঠবেই।' পাশে তখন দাঁড়িয়ে হায়দারের মা জাইবন খাতুন। চোখের কোণটা আঁচলে মুছে মিজানুরের কথা ধরেই ছেলেকে তখন সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তিনি।
নাগরিকপঞ্জির সংশোধিত খসড়ায় জাইবনের নাম আছে। আছে হায়দারের দাদা জাইদর ও বোন রিনার নামও। শুধু হায়দরের নাম নেই।
শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, 'এই ছেলেটাই (হায়দার) গত বছর দেশপ্রেমের প্রতীক হয়ে গিয়েছিল। গলা জলে দাঁড়িয়ে ভারতীয় পতাকাকে ওর স্যালুট করার সেই ছবিটা আমি তুলেছিলাম। ফেসবুকে দেওয়া মাত্রই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। আর এ বছর, ও নাকি ভারতীয়ই নয়! কোথাও একটা বড়সড় গণ্ডগোল হয়েছে।'
বছর ছ'য়েক আগে কোকরাঝাড়ে জঙ্গি হামলায় নিহত হন হায়দরের বাবা রুপনাল খান। মা জাইবন শালমারারই একটি স্কুলে মিড ডে মিলের রান্না করেন। মাসে হাজারখানেক রুপি পান। তাই দিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনও রকমে সংসার চালান। কষ্টের সেই জীবনে ছোট ছেলেকে নিয়ে নতুন এই বিড়ম্বনা। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। স্কুলের দ্বারস্থ হয়েছেন। সকলেই আশ্বস্ত করছেন, নাম উঠে যাবে। কিন্তু, যারা আশ্বস্ত করছেন, তারাও জানেন না, সত্যিই হায়দরের নাম উঠবে তো!
গত ৩০ জুলাই আসামের নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশ হলে দেখা যায়, গ্রামের অনেকের মতো হায়দরের নামও তালিকায় নেই। হায়দরের মা জানান, এনআরসি সেবা কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, হায়দারের জন্মসনদে সম্ভবত গোলমাল আছে। সেবা কেন্দ্র সূত্রে বলা হচ্ছে, গ্রামে নারীদের অনেকের প্রসবই হাসপাতালে হয় না। পরে জন্মসনদ সংগ্রহ করতে যায় পরিবার। তখনই কোনও গোলমাল হয়ে থাকতে পারে। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন