বাংলাদেশে মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত চলমান অভিযানে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রায় দুই শতাধিকেরও বেশি লোক নিহত হয়েছেন। এই অভিযান নিয়ে ১৩ আগস্ট একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স। এতে ‘মাদক ব্যবসায়ীরা’ গ্রেফতার হওয়ার পর কিভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এক এক নিহত হচ্ছেন তার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
রয়টার্স প্রকাশিত প্রতিবেদনটির হুবহু ভাষান্তর ব্রেকিংনিউজ.কম.বিডি-এর পাঠকদের জন্য নিচে তুলে ধরা হলো:
শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরার পথে রেজাউল ইসলামকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশের পুলিশ। ঢাকার উত্তরে একটি রেললাইনের পাশে বালির মাঠে ভোর ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পুলিশ দাবি করে, অন্যান্য মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিনি নিহত হয়েছেন এবং তারা সেখান থেকে ২০ কেজি মারিজুয়ানা (গাঁজা) উদ্ধার করেছে। কিন্তু নিহতের বাবার দাবি, পুলিশের কর্তারা তার কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করেছে এবং তারপরেও তাকে তারা হত্যা করেছে।
তার মা রিনা বেগম বলেন, ‘আমি জানতাম যে আমার ছেলে পুলিশ হেফাজতে ছিল। হঠাৎ করেই আমার ছেলে মারা গেল। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারি না। পুলিশ টাকা নিল এবং তারপরেও তারা তাকে মেরে ফেলল।’
রাষ্ট্রীয়-সহায়তায় মাদক-ব্যবসায়ীদের দমন অভিযানে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার নতুন ফ্রন্টলাইন এবং গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অভিযান শুরুর ঘোষণা দেয়ার পর থেকে প্রায় ২০০ জন লোক পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে। রেজাউল ইসলাম তাদেরই একজন।
সমালোচকরা বলছেন, ডিসেম্বরে দেশটির আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে এই দমন অভিযানে শেখ হাসিনার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিফলিত হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাম্প্রতিক ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভের সময়ও এই দমন অভিযান দেখা গেছে। একজন বিশিষ্ট ফটোগ্রাফারকে (শহিদুল আলম) গ্রেফতারসহ বিক্ষোভ দমনে রাবার বুলেটের ব্যবহার করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংস আন্দোলনগুলো পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি যেভাবে মোকাবিলা করেছে, একইভাবে এখন মাদকের সমস্যাটি তারা মোকাবেলা করবে।’
সরকার মনে করছে এই ধরনের অভিযান ভোটারদের মাঝে জনপ্রিয় হতে পারে; যেমনটি দেখা গেছে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের রক্তাক্ত মাদকযুদ্ধে।
এই ড্রাগ অভিযান একটি জনপ্রিয় পরিকল্পনার অংশ ছিল কিনা-এমন প্রশ্নে শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে কোনও জবাব দেয়া হয়নি।
দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর সারি
শেখ হাসিনার দৃঢ় বক্তব্যের পর মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফিলিপাইনের মতোই হত্যাকাণ্ডের পর একটি স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করে বলা হয়, সন্দেহভাজনদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে এবং সেখান থেকে মাদক ও অস্ত্র পাওয়া গেছে।
ঢাকা-ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ কর্তৃক রেকর্ডকৃত তথ্যে দেখা যায়, গত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া ২১১ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি সন্দেহভাজনকে হত্যা করার আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
তবে, সন্দেহভাজনদের হত্যার বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অস্বীকার করেছেন।
রয়টার্সকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের আইন প্রয়োগকারীরা মানুষকে হত্যা করে না, তারা কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয় না। এটা অসম্ভব। যদি তারা তা করে তবে তাদের সেই মুহূর্তেই বরখাস্ত করা হয়। এটি আইনহীন দেশ নয়।’
পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, রেজাউল ইসলাম গ্রেফতার হওয়ার পর, আশেপাশের এলাকার ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ ও অন্যান্য ড্রাগ বিক্রেতাদের ধরতে পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে রেললাইনের পাশের মাঠে নিয়ে যায়। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি বুঝতে পেরে অন্য মাদক ব্যবসায়ীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালায় এবং ‘জীবন ও সরকারি সম্পত্তি বাঁচাতে’ তারা পাল্টা গুলি ছোঁড়ে।
রিপোর্টে বলা হয়, ওই গোলাগুলির মধ্যে পড়ে রেজাউল ইসলামের শরীরে গুলি লাগে। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। দুই পুলিশ কর্মকর্তাও আহত হয় বলে দাবি করা হয়।
এর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়, তার বামে কানের পাশ দিয়ে একটি বুলেট তার মাথা ভেদ করে সেটি ডান কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
পুলিশের রিপোর্টে উল্লেখ করা ৬ সাক্ষীর মধ্যে কেউই রেজাউল ইসলামের বন্দুকযুদ্ধে নিহতের বিষয়টি স্বীকার করেনি।
৬ সাক্ষীর একজন মোহাম্মদ বাপ্পি। রেজাউল ইসলাম যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, তার পাশেই বসবাস করেন তিনি। মৃতদেহের ছবিতে দেখা যায়, ভূমিতে পড়ে থাকা মৃতদেহের মাথার নিচে রক্ত জমাট হয়ে আছে।
তিনি বলেন, ‘এটা কোনও ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ছিল না। যদি ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হতো, তবে আমরা দুপক্ষের কাছ থেকে গোলাগুলির অনেক শব্দ শুনতে পেতাম। কিন্ত তা ঘটেনি।’
ওই অপারেশনের নেতৃত্ব দেয়া পুলিশ কর্মকর্তা কামাল হোসেন জানান, মাদকদ্রব্যের ব্যবহার অপরাধের দিকে নিয়ে যায় এবং গ্রেফতার কোনও কাজ করে না।
তিনি বলেন, ‘তারা জামিনে বেরিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে একই কাজে জড়িত হয়। মাদক বিক্রি ও তা ব্যবহার করে। প্রত্যেক ড্রাগ ব্যবসায়ীকে হত্যা করা উচিত। তবেই মাদক নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশে সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মে মাসে দক্ষিণাঞ্চলীয় টেকনাফে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) হাতে একজন নিহতের পর রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন মানবাধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে পুলিশের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তার কাছে একটি চিঠি পাঠায়।
কিন্তু শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেন, ‘ড্রাগস একটি দেশ, একটি জাতি এবং একটি পরিবার ধ্বংস করে দেয়।’
গেল জুন মাসে তিনি সংসদে বলেন, ‘আমরা এই অভিযান অব্যাহত রাখব। কে কী বলল তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।’
কথিত মাদকবিরোধী অভিযানে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডই গত মে মাসে সংঘটিত হয়। ওই সময় ১২৯ জন নিহত হয়েছিল। তবে, জুন মাসে তা কমে ৩৮ জনে দাঁড়ায়। কিন্তু জুলাই মাসে তা বাড়তে থাকে। এই সময়ে নিহত হয় ৪৪ জন।
মাদকের বিস্তার বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে মদ্যপানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ভাষান্তর: রুহুল আমীন
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন