বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনার লক্ষ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে কোম্পানি করা হয়েছে ১১ বছর আগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কোনো কার্যকর জনবলকাঠামো তৈরি করা যায়নি। নেই কোনো অনুমোদিত চাকরিবিধিও। ফলে নিয়োগ, পদোন্নতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ব্যাপক।
বিমান সূত্র জানায়, ১ কোটি ২২ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি জনবলকাঠামো তৈরি করা হয়েছিল অনেক আগে। কিন্তু তা কার্যকর করা হয়নি। ফলে তিন ধরনের কর্মী তিন রকম বেতন-ভাতায় একই কাজ করছেন। কেউ আছেন স্থায়ী কর্মী পেনশনপ্রাপ্য (পি নম্বরধারী), কেউ আছেন জি নম্বরধারী, যাঁরা পেনশন পাবেন না, তবে গ্র্যাচুইটি পাবেন। আরেক প্রকার আছেন চুক্তিভিত্তিক দৈনিক মজুরি হিসেবে (সি নম্বরধারী), যাঁরা ক্যাজুয়াল কর্মী হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে মোট জনবলের প্রায় অর্ধেকই ক্যাজুয়াল, এর সংখ্যা এখন ২ হাজার ৪০০ জন। আবার, স্থায়ী কর্মীদের ওপর চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভও আছে।
চাকরিবিধি এবং একটা যথাযথ জনবলকাঠামো কার্যকর করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ এনামুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর চেষ্টা ছিল চলতি বছরের জুনের মধ্যে এটা করার। কিন্তু কিছু কারণে হয়নি। আরেকটু সময় লাগবে। তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিমান ফ্লাইট পরিচালনা করে না, তারপরও হংকংয়ে অফিস আছে, কান্ট্রি ম্যানেজার আছেন। আবার সেখানে জিএসএ (জেনারেল সেলস এজেন্ট) আছেন। একইভাবে কানাডায় ও যুক্তরাষ্ট্রে অফিস ও জনবল ছিল বছরের পর বছর। সেটা বন্ধ করা হয়েছে।
ব্যবসা প্রসার ও যাত্রী আকর্ষণের লক্ষ্যে হলিডে উইং খুলেছে বিমান। এ জন্য বলাকা ভবনে আলাদা অফিসকক্ষ ও জনবল আছে। কিন্তু এই উইং চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একটি বেসরকারি ভ্রমণ কোম্পানিকে। এটি বিমানের বিপণন ও বিক্রয় শাখার অধীন। এ বিষয়ে বিমানের বিপণন ও বিক্রয় শাখা থেকে সদ্য বদলি হওয়া পরিচালক মো. আলী আহসান দাবি করেন, এটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছে।
দেশে-বিদেশে অসংখ্য ট্রাভেল এজেন্সি বিমানের টিকিট বিক্রি করছে। বিমানের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র ও জনবল রয়েছে। তারপরও কেন আরও বেশি কমিশনে পুরো ব্যবসা একটি বাইরের প্রতিষ্ঠানকে ছেড়ে দেওয়া হলো? এর জবাবে আলী আহসান বলেন, বেশি কমিশন দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে সেটা কত, তাঁর মনে নেই।
কেবল হলিডে উইংসই নয়, ওই একই কোম্পানির সহযোগী আরেক ভ্রমণ-সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে বিমানের ইন্টারনেট বুকিং ইঞ্জিন এবং বিমানের লয়্যালিটি ক্লাবের সদস্য যাত্রীদের টিকিট বুকিংসহ বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব।
১ জুলাই থেকে নতুন প্রতিষ্ঠান তার সফটওয়্যার সংযোগ দিয়ে পুরোনো সংযোগের প্রতিস্থাপন করার কথা। কিন্তু এক মাস পরও সেটা চালু করতে পারেনি। এক মাস আবার আগের প্রতিষ্ঠানকে ফিরিয়ে আনা হয়। আরে আগে নতুন প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার প্রতিস্থাপন এবং পরীক্ষামূলক চালু করতে গিয়ে অসংখ্য হিট পড়েছে জিডিএস কোম্পানি সিটার সাইটে (যা থেকে টিকিট বুকিং বা বিক্রির খুদে বার্তা পাঠানো হয়)। এসব হিট বাবদ সিটাকে ফি দিতে হবে কি না, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতিতে নৈরাজ্য
বিমানের বিপণন শাখার মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) আতিকুর রহমান চিশতি এর আগে লন্ডনে বিমানের ব্যবস্থাপক ছিলেন। মেয়াদ শেষে তিনি ঢাকায় ফিরে না আসায় চাকরি হারান। এখন তাঁকে আবার জ্যেষ্ঠতাসহ নিয়োগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কার্গো শাখায় ৫৫টি স্থায়ী পদ খালি ছিল। এর বিপরীতে ১০০ জনকে চুক্তিভিত্তিক কমার্শিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ করা হয়। পরে আবার স্থায়ী পদে ৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদের দাবি, স্থায়ী পদের জন্য তাঁরা অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। অভিযোগ উঠেছে, চুক্তিভিত্তিক ও স্থায়ী-দুই নিয়োগেই বাণিজ্য হয়েছে।
এ বিষয়ে আলী আহসান বলেন, ৫৫ স্থায়ী পদ ও ১০০ জন অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ আলাদাভাবে চাওয়া হয়েছিল। এখন অস্থায়ী কর্মীরা তাঁদের স্থায়ী করার দাবি জানাচ্ছেন। বিমানের জনবলকাঠামো তৈরি হয়ে গেলে এই সমস্যা থাকবে না।
ফ্লাইট সার্ভিস শাখায় নিয়োগ, পদোন্নতিতেও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে। এখানে স্থায়ী কর্মীদের ওপর পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদের। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত দুজন জুনিয়র পার্সারকে সম্প্রতি নতুন চুক্তি করে অন্য সব জুনিয়র পার্সারের (স্থায়ী কর্মীসহ) ওপর নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে ২২০ পার্সারের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
প্রশাসন শাখার একটি সূত্র বলছে, দৈনিক মজুরিভিত্তিক বা ক্যাজুয়াল হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে ৮৯ দিন পর তাঁদের অন্তত এক দিন কর্মবিরতি দেওয়ার নিয়ম। অন্যদের ক্ষেত্রে তা করা হলেও তাঁদের ক্ষেত্রে করা হয়নি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাঁরা আদালতে যান। এরপর বিমান তাঁদের সঙ্গে আদালতের বাইরে সমঝোতা করে সম্প্রতি নতুন করে তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করেছে এবং তাঁদের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়েছে স্থায়ী কর্মীদের ওপরে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে আদালতে যাওয়া অন্য কর্মীদের ক্ষেত্রে বিমান কর্তৃপক্ষ এমন উদারতা দেখায়নি; বরং আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে একের পর এক আপিল করেছে, পক্ষে রায় পাওয়ার পরও অনেককে দীর্ঘদিন ঘুরিয়েছে।
২০১৪ সালে লন্ডনে নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পদোন্নতি দিয়ে ব্যবস্থাপক করা হয়। বর্তমানে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন উপমহাব্যবস্থাপকের। আর যিনি যৌন হয়রানির শিকার, তিনি চাকরি হারিয়েছেন।
এসব অনিয়মসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে গত ২৮ মে বিমানের মুখপাত্র জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপকের মাধ্যমে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন